বিশ্বকাপ শুরু হবার পর থেকেই ঘরের ভিতর স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মাঠের খেলা আর মাঠেই নেই; মনের ভিতরও শুরু হয়েছে। শুরুটা অবশ্য আমিই করেছিলাম। সুখে থাকতে ভূতে কিলায় বলে একটা কথা আছে না? সুখেই ছিলাম। এখন ভূতের রামকিল খেয়ে রাতদিন চোখে সর্ষেফুল দেখার অবস্থা।
ঘটনা তাহলে খুলেই বলি। সেদিন ছিল ওর জন্মদিন। "ও" কে? "ও" হলেন আমার উনি! ঘরের লোক, ঘরণি। কেক-টেক কাটার পর্ব শেষ হতে আমি উনাকে একটা সারপ্রাইজ গিফট দিলাম। উনি খুশি মনে আমার গিফট গ্রহন করলেন। প্যাকেট খোলার পর থেকেই সারপ্রাইজ গিফট আমার জন্য বিরাট পেইন নিয়ে আসল।
তিনি একজন ব্রাজিল সাপোর্টার। আমি তাকে ক্ষেপানোর জন্য উপহার দিয়েছি আর্জেন্টিনার দশ নম্বর জার্সি! ক্ষেপানোর হেপা যে এতদূর গড়াবে তা কে জানত! আমি প্রবলভাবে মেসির ভক্ত। সারাদিন মেসির গুনগান গাই।
যাই হোক, প্যাকেট খোলার পর তার মুখের হাসি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেল। চোখদুটো জ্বলতে শুরু করল। তারপর সেই জ্বলজ্বলে চোখের আগুনে আমাকে পুড়িয়ে দিয়ে উনি গটগট করে হেটে গিয়ে বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি বিমর্ষ হয়ে ভাবতে লাগলাম, আজকের রাতটা সোফার উপর মশাদের আতিথ্য গ্রহন করতে হবে। এই পর্যন্ত যতবার দরজা বন্ধ হয়েছে, ততবার তাই করতে হয়েছে।
ভেবেছি ঘটনা বোধহয় এখানেই খতম। পরেরদিন অফিস থেকে ফেরার সময় আমরা চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। আমার বাসা পাঁচতলায়। সেই পাঁচতলার বারান্দা থেকে বিরাট এক হলুদ পতাকা নিচতলা অবধি ঝুলছে! আমার বাসায় ব্রাজিলের পতাকা! এ দেখার আগে আমার...........!!
খেতে বসে দেখি তরকারী সব হলুদ দেখতে লাগলাম। হলুদ বেশি হয়েছে? নাকি মাথাটাই বিগড়ে গেল? মুখে দিয়ে দেখি হলুদ আসলেই বেশি। উনি দিব্যি খেয়ে নিচ্ছেন! কোন বিকার নাই। আমাকে জব্দ করতেই উনার এই বুদ্ধি! কোনমতে ঐ হলুদ পদার্থগুলা গলধকরন করলাম।
পরেরদিন অফিস যাবার পথে নিচতলার ভাড়াটে বললেন,
"ভাই, আপনাকেতো আর্জেন্টিনার পাগলা সাপোর্টার বলেই জানতাম। ভোল পাল্টালেন কবে? এফিডেভিট করিয়েছেন?" বলেই একটা মিচকা হাসি দিয়ে আমার পিত্তি জ্বালিয়ে দিল। বলাই বাহুল্য তিনিও হলুদের দলের লোক।
অফিসে যেয়েই মোবাইল দিয়ে ফেসবুকে একটা "হলুদ কার্ড" এর ছবি আপলোড দিয়ে উনাকে ট্যাগ দিলাম। উনাকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে দিলাম। আমিও পারি! এইবার মনটা একটু শান্ত হল।
আমার অফিসটা বাসা থেকে বেশি দূরে না। হেটে গেলে ৫-৭ মিনিট লাগে। লাঞ্চ টাইমে বাসায় এসে লাঞ্চ করি। সেদিন বাসায় ফিরে দরজার নব ধরে মোচড় দিয়ে দেখি দরজা খোলা না। ভিতর থেকে লক করে দিয়েছে। কলিংবেল টিপলাম কয়েকবার। তাও খোলে না। একটু পর দরজার নিচ দিয়ে একটা "লাল কার্ড" বেরিয়ে এল!
আমি হতাশ হয়ে বুঝে নিলাম আজকের লাঞ্চটা আমাকে বাইরেই করতে হবে। তবে আমিও দেখে নেব। এতসহজে ছেড়ে দেব না। অফিসে গিয়েই একটা স্ট্যাটাস দিলাম, "ছোটবেলায় মেয়েদের দেখেছি মানুষকে খাইয়ে আনন্দ পেত। কি কলিযুগ আসল! এখনকার মেয়েরা মানুষকে ভুখা রেখেই আনন্দ পায়!"
অফিস শেষে বাসায় ফিরে দেখি ভার্সিটি পড়ুয়া ছোট বোন এসেছে। আমাকে দেখে ফিচকা একটা হাসি দিল। আমি বুঝলাম, আমার শান্তি শেষ। একজনের জ্বালায় বাঁচি না। একজন আরেকজন এসে মহাজোট হয়েছে। আমাকে একা পেয়ে ছন্দে ছন্দে বলল,
"ভাইয়া, তুমি না আর্জেন্টিনার এত্ত বড় ফ্যান!
তোমার বাসায় ব্রাজিলের পতাকা ক্যান?"
আমি ওর গলা চেপে ধরার ভঙ্গি করতেই সে "ভাবিইইই!!!" বলে একটা চিৎকার দিয়ে পালিয়ে গেল।
পরেরদিন অফিসে যাবার সময় বাসার চাবি নিয়ে নিলাম। লাঞ্চ আওয়ারে এসে দেখি যথারীতি লক করা। হে হে...আজকে আমার কাছে চাবি আছে! তালা খুলে নিজের বাসায়তেই চোরের মত ঢুকলাম! উনি তখন শাওয়ারে বিজি। আমি পেটপুড়ে ভাত খেয়ে নিলাম। তারপর ভাতের মধ্যে ঢেলে দিলাম পানি। তরকারীতেও পানি দিব কিনা ভাবলাম। থাক! আর্জেন্টিনার সাপোর্টাররা এত নিষ্ঠুর না! একটু দয়ামায়া আছে তাদের অন্তরে। খাওয়া শেষে যেভাবে এসেছিলাম, সেভাবেই অফিসে ফিরে গেলাম।
বাসায় ফেরার পথে পাশের দোকানে ৪ ফিট বাই ২.৫ ফিট একটা পোস্টার দেখলাম মেসির। কিনে নিলাম। বাসায় এসে সদর দরজায় লাগিয়ে দিলাম। ঘরে ঢুকে দেখি উনি কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাচ্ছেন। আমি এমনভাব করতে লাগলাম যেন আমার মত সহজ-সরল, নিষ্পাপ লোক আল্লাহ পৃথিবীতে একজনই পাঠিয়েছেন!
পরেরদিন লাঞ্চের সময় বাসায় এসে দরজার অবস্থা দেখে আমার মাথায় হাত! হায়! হায়! এটা কি হল?
মেসির হাতে কাপ ছিল। এখন দেখি কাপ নেই। হাতে লাউ দেখা যাচ্ছে! একটানে ছিড়ে পোস্টার ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম।
রাগে ফুলতে ফুলতে বাসায় ঢুকলাম। আজকে অবশ্য লক করা ছিল না। বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমি চাবি চুরি করেছি। একটু পর আসল ঘটনা বুঝলাম।
খেতে বসে দেখি আমার পছন্দের সব তরকারী! ঘটনা কি? কোন দুসরা ছাড়বে কে জানে! আরে, মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল নাকি? ফুটবল খেলায় দুসরা আসবে কোথ্যেকে?
যাইহোক, সন্দেহের দৃষ্টিতে তরকারীগুলো দেখতে লাগলাম। অল্প একটু মুখে দিয়ে তারপর পাতে নিচ্ছি। উনি আমার কান্ডকারখানা দেখে ফিচকা ফিচকা হাসতেছেন আর গুনগুন করে গান গাইতেছেন।
গলাটা বড় মিষ্টি। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। উনি বুঝতে পেরেই মনে হয় গলা আরেকটু চড়িয়ে দিলেন।
"মাছি যখন লাউ লইয়া
আমার দরজার সামনে দিয়া..."
"তবেরেএএএ............"
আমি খাওয়া ফেলে এক ঝটকায় উঠে দৌড়ানি দিলাম। উনি অবশ্য আমার আগেই দৌড়ে বেডরুমে ঢুকে দরজা লক করে দিয়েছেন। দরজার ভিতর থেকেও উনার হাসি আমার কানে আসছিল।
হায় খোদা! চোখ বন্ধ করা যায়, মুখ বন্ধ করা যায়, কান কেন বন্ধ করা যায় না??
আমাদের এই যুদ্ধ শেষ হল আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার পর। ব্রাজিল হারার পর আমি উনার চোখের পানি মুছে দিলাম। আর আর্জেন্টিনা হারার পর উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
অতঃপর আমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলাম।
No comments:
Post a Comment