আজ আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে।
গতকাল ফোনে কথা বললাম। একা একা চার বস্তা ধান সিদ্ধ করেছেন, ছাদে তুলেছেন, শুকিয়েছেন। এরই ফাকে রান্না করেছেন, বোনের বাসায় যেয়ে তাকে হেল্প করেছেন। ধান নিয়ে যাদের নাড়াচাড়া করার অভ্যাস আছে তারা জানে, ধান প্রসেসিং কত হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কাজ। আমি এত মানা করি। শোনে না।
ছোটবেলা থেকেই দেখছি এই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম। ধানের সিজন আসলেই বস্তা বস্তা ধান বাড়ি থেকে আসত। খুব ভোরে ঘুম ভাঙত ধান সিদ্ধকরার গন্ধে। আব্বার অফিস ছিল আটটায়। অফিসে যাবার আগেই আম্মার সিদ্ধকরা ধান ছাদে তুলে দিয়ে যেতেন। আবার হয়ত লাঞ্চব্রেকের সময় আধঘন্টা আগেই চলে আসতেন। আব্বাকে ধান টানাটানি করতে দেখে আমরাও ধান নিতাম ছাদে। আব্বার মত বস্তা দিয়েতো আর পারব না। আমাদের জন্য আম্মা ছোট ছোট বোল বের করে দিতেন। আমি আর আমার ছোটভাই পাল্লা দিয়ে ধান তুলতাম। কে কত বোল ধান ছাদে তুলেছে হিসাব রাখতাম। তারপর আম্মার কাছে যেয়ে বলতাম। আমি যখন আম্মার কাছে যেতাম তখন আম্মার আমাকে বলতেন, "তুমি ফাস্টোওও"। আবার আমরা ছোটভাই গেলে তাকেও বলতেন, "তুমি ফাস্টো হইছো।" আমরা দু'ভাই-ই ফাস্টো হবার আনন্দে হাসিমুখে ঘুড়ে বেড়াতাম।
আমাদের কাজ ছিল ধান পাহাড়া দেয়া। পাখি যেন না আসতে পারে। স্কুল থেকে ফিরেই ছাদে! এই সুযোগ ক'জন হাতছাড়া করে? মার্বেল অথবা ঘুড়ি নাটাই নিয়ে একদৌড়ে ছাদে। মাঝে মাঝে ক্যারম বোর্ডও উঠানো হত। খেলার ফাঁকে ফাঁকে "হুসসস্...হুস, হুস"...কবুতর, চড়ুই, শালিক তাড়াই।
যেদিন আম্মার মেজাজ মর্জি ভাল বুঝতাম সেদিন বলতাম,
"আম্মা আসো ১৬ গুটি খেলি..."
"তুই আমার লগে পারবি?"
পারব না সেটা আমিও জানি। আম্মার ইটের টুকরা দিয়ে ছাদের মেঝেতে ১৬ গুটির নকশা করেন। আমি তাকিয়ে থাকি। শেখার চেষ্টা করি। বাস্তবিকই আম্মার সাথে আমি দাড়াতেই পারতাম না। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার গুটি সব কোটের বাইরে চলে যায়। হেরে যাওয়া ছেলের ছলছল চোখ দেখে আম্মা মিটিমিটি হাসেন।
এরমধ্যে যদি বৃষ্টি আসে তবে দৌড়া দৌড়ি শুরু হয়ে যায়। ধান ভেসে যাচ্ছে। সবাই মিলে ধান টেনে সিড়িঘরে নিয়ে আসা। শার্টখুলে, পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে ছাদের পাইপের মুখ বন্ধ করে পানিতে ভেসে যাওয়া ধান আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা। তারপর অপেক্ষা কখন বৃষ্টি থামে। দু'একবার এমন হয়েছে বৃষ্টি আর থামে নি। টানা ঝড়েছে। ভেজা ধান ঘরে থেকে গন্ধ বেড়িয়েছে। সেই গন্ধ চাল করার পরও থেকে যায়। রান্না করা ভাতেও গন্ধ। সেই গন্ধভাত কে খায়? আমরা তিন ভাই বোনেই কেউ সেই ভাতের ধারে কাছেও যাই না। আব্বা-আম্মা খায়। তাদের কাছে গন্ধ লাগে না।
ধানের সিজন এলে মাঝে মাঝে আমার খালাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের বাসায় আসতেন। আম্মাকে হেল্প করতেন। ধান ভাঙানোর সময় আরেক মজা। আব্বার সাথে বাজারে যাওয়া যেত। আব্বার সাথে বাজারে যাওয়া মানেই এটা ওটা কেনা যাবে। এইজন্য আব্বা সাধারনত আমাকে বাজারে নিতে চাইতেন না। কারন আমি বাজারে যাওয়া মানেই একটা না একটা খেলনা কেনা। বিশেষ খেলনা গাড়ি কেনার জন্য "মর্জি" (গো) করতাম খুব।
তারপরও আব্বা যখন বলতেন, আমি যাইতাছি। তরা রেডি হইয়া আয়। আমরা দু'ভাই মিনিটের মধ্যে শার্ট, প্যান্ট, স্যান্ডেল পড়ে রাস্তায় এসে দেখি, আব্বা লম্বা, লম্বা পা ফেলে কতদূরে চলে গেছেন! আমরা দু'ভাই দৌড়ে যেয়ে দু'পাশ থেকে আব্বার দু'হাত ধরেছি। ছবিটা মাঝে মাঝে আমার চোখে ভাসে। একজন বাবা তার দু'ছেলে দু'পাশে রেখে হাতে হাত ধরে হাটছেন!
দু'মেয়ের পর আমার জন্ম। সবার কাছেই আমার আদর ছিল বেশি। আমার ইমিডিয়েট বড়বোন ছোটবেলাতেই মারা যাওয়ায় আমার প্রতি সবাই আলাদা যত্ন নিত। ছেলের ঘরে প্রথম নাতি আমি! আমার দুষ্টুমির শেষ নাই।
আমার দুষ্টুমির যেমন শেষ ছিল না তেমনি দুষ্টুমির জন্য মারও কম খাইনি। ঝাড়ু, স্যান্ডেল, লাঠি (তরকারী রান্নার জন্য আম্মার ব্যবহৃত লাঠি-এখনো বর্তমান আছে) কোন কিছু বাদ যায় নি। শক্ত মার দেয়ার পর আম্মা হয়ত আমাকে ঘরে আটকেই রাখতেন। আমি এককোনায় বসে কাঁদতে থাকতাম। বেশিরভাগ সময়ই ঘর থেকে বের করে দিতেন। মাঝে মাঝে দু'ভাইকে একসাথেই বের করে দিতেন। প্রচন্ড জেদি আমার রাগে-দুঃখে মনে হত কোথাও চলে যাই। কিন্তু যেতাম না কোথাও সিড়িতে বসে ফোঁপাতাম। আব্বা যখন অফিস থেকে ফিরতেন তখন তার সিড়িতে বসে থাকা আমাদের নিয়ে ঘরে ঢুকতেন। কিন্তু কিসের কি! দু'একদিন ঠান্ডা থাকার পর আবারো আমাদের দুষ্টুমি শুরু হত।
আমি অফিসের জন্য চিটাগাং। ছোটভাই ভার্সিটিতে। ছোটবোন যায় স্কুলে। বড়বোন তার সংসারে ব্যস্ত। আম্মা বাসায় থাকেন একা। উপরের হাবিজাবি কথাগুলো ভেবে, আমাদের কত মেরেছেন এসব ভেবে আম্মা এখন একা একা কাঁদেন। হায়রে মায়ের জাত!
গতদু'দিন ধান টানা হেচড়া করে আম্মার হাত-পা, শরীর ব্যথা হয়ে গিয়েছে। জ্বর এসেছে কিনা বলতে চায় না। বললেই যদি আমি রেগে যাই! বাসায় মলম নেই, মলম মালিশ করে দেবার মতও কেউ নেই।
কয়েকদিন বাসায় না গেলেই আম্মার এটা সেটা রোগ দেখা দেয়। শরীর ভাল লাগে না, রাতে ঘুম আসে না। হাবিজাবি কত কিছু!
মাঝে মাঝে মনেহয়, কি দরকার এই চাকরী-বাকরি করার? কি হবে এই টাকা পয়সা দিয়ে। সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাই। মায়ের চোখের সামনে সামনে থাকি। আমার আম্মার সবচে' বড় এন্টিবায়োটিক হলাম আমি! আমি বাসায় গেলেই আম্মার সব ঠিক। শরীর ভাল হয়ে যায়, ঘুমের সমস্যা নেই। ডাক্তারের কাছ যাওয়ার কথা বললে বলেন, ডাক্তারের কাছে যাব কেন? ডাক্তার কাছে যেয়ে লাভ নেই।
ভয়হয়, ছোটবেলায় আম্মা যত যন্ত্রণা সহ্য করে আমাকে আগলে রেখেছেন তার সিকিভাগও আমি সহ্য করতে পারব কিনা। আব্বা বলেছিলেন, "তর মারে কষ্ট দিছ না।" জানি না, সেই দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পারব।
[এইধরনের পোস্ট আগেও দিয়েছি। আমার মনে হয় যতদিন বেচে থাকব এইধরনের পোস্ট দিব]
No comments:
Post a Comment