আজকের দিনটাই অন্যরকম। চারিদিকে মনে হচ্ছে বসন্তের ছোয়া লেগেছে। সবকিছু রঙিন মনে হচ্ছে। বিকলে বেলার সময়। মৃদু বাতাস বইছে।আমার রিকশাটাও ছুটছে মসৃণভাবে।ভাবতে না ভাবতেই ছোট একটা গর্তে রিকশার চাকা পড়ল।
"দেখ, বেদ্দপি করিস না। আমি বিয়া করলেই কি, তুই আমার প্রথম প্রেমিকা। তোরেই আমি বেশি ভালবাসি। আমার ভালবাসার মূল্য দিস। নতুন বউরে ঝাকি দিয়া কষ্ট দিস্ না।"
পিছনে খিল খিল হাসি শুনে ফিরে তাকালাম,
"বউ হাসস্ ক্যা?"
"আপ্নের কথা হুইন্যা হাসি।"
"আমি আবার হাসির কি কইলাম?"
"ঐযে কইলেন আপনে নাকি আপনের রিকশারে আমার চাইতে বেশি ভালবাসেন; এইডা হুইন্যা হাসি।"
"হাসির কথা নারে বউ। জ্ঞান হইবার পর কেডা বাপ, কেডা মা, কইতে পারি না। এইহানে ঐহানে থাইক্যা বড় হইছি। কাগজ টোকাইছি, বোতল, পলিথিন, সবই টোকাইছি। সারাদিন এইগুলা কইরা কোন রকম চলছি। থাকনের কোন জায়গা আছিল না। কত রাইত ইস্টিশনে শুইয়া মশার কামড় খাইছি কোন হিসাব নাই। আমারে একলা থাকতে দেইখ্যা ইস্টিশনের পাহাড়াদার কাকায় মাঝে মাঝে দু-এক টাকা দিত। কাকায় আমারে খুব আদর করত। গরীব মানুষ আছিল। তেমন কিছু করতে পারে নাই আমার লাইগ্যা। তয় আদর কোনদিন কম করে নাই।"
"একটু যখন বড় হইছি কাকায় এক রিকশার গ্যারেজে নিয়া গেছিল। মহাজনরে কইয়া আমার লাইগা একটা রিকশার ব্যবস্থা কইরা দিছিল। হে আসলে মহাজন না, হে হইল মহাহারামী। ঠিকঠাক মত টেকা না দিতারলে মারত। পোলাপানা আছিলাম কিছু কইতাম পারতাম না। কইলে যদি পরেরদিন রিকশা না দেয়। মহাজনের রিকশা বহুদিন চালাইছি। রিকশা চালানের টাকা দিয়াইতো তগো বস্তিতে একটা ছোট্ট ঘর নিলাম একদিন। আর আস্তে টেকা জমাইয়া এই রিকশাডা কিনছি। কিনার পরে মহাজনের মুখে থুথু মাইরা হের রিকশা ফালাইয়া দিয়া আইছি।"
"আপনে খালি দুঃখের কতা কন।"
"দুঃখের কতা নারে বউ। এই রিকশা কিনার টেকা জোগাড় করতে গিয়া বয়স বাইড়া গেছে। আগে টেকা জমাই নাই, যা কামাই করছি সারাদিনে। পরেরদিন সব খরচ করছি। নাইলে আরো আগেই তরে বিয়া করতে পারতাম। তুই শেষমেষ একটা বুইড়া জামাই পাইলিরে বউ!"
"কেডা কইছে আমার জামাই বুইড়া?? দাত ভাইনঙ্গা দিমু না!!!"
পুলি আর আমি একই বস্তিতে থাকতাম। আমার চোখের সামনেইতো বড় হল। ছোটবেলা থেকেই বস্তির অন্য ছেলেপেলে থেকে পুলি একটু অন্যরকম ছিল। চুপচাপ থাকত। শুধু আমাকে দেখলে চোখ বড় বড় করে তাকাত। বিয়ের পর আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি কেন সে অমন করত। কিন্তু পুলি আমার কথা জবাবে মুচকি হাসে শুধু। বেশি জোড়াজুড়ি করলে বলে, "আরে ছোটকালে কি করছি মনে আছে নাকি!!"
"জানস বউ, এই রিকশা নিয়া মজার কাহিনী আছে।"
"কি কাহিনী?"
"অহনকার কিছু বেতমিজ পোলা মাইয়া আছে যারা রিকশায় উঠে আকাম-কুকাম করার লাইগা। এইরাম কোন পোলা মাইয়া যদি আমার এই রিকশায় উঠত তাইলে রিকশার ব্রেক ফেল করত। আমি তাগোরে কইতাম, শক্ত হইয়া বসেন। গাড়ির ব্রেক ফেল করছে। এই কতা হুইন্যা হেরা ডরে টাইট হইয়া বইসা থাকত। ইতরামি করতে পারত না। পরে রিকশা আস্তে আস্তে থাইম্যা গেলে ওরা নাইম্যা যাইত। টেকা নিয়াও তেড়িবেড়ি করতে পারত না। লগে মাইয়ালোক থাকলে পুরুষ মাইনষ্যের ছাতি বড় হইয়া যায়।"
"সত্যই ব্রেক ফেল করত?"
"হ।"
"যদি একসিডেন্ট কইরা ব্যথা পাইতেন??"
"আল্লায় বাচাইছে আমারে। নাইলে কত মাইনষ্যের কত কিছু হয়। আল্লার রহমতে আমার কিছু হয় নাই আইজ পর্যন্ত।"
"আপনে কইলাম আর কুনুদিন ওইরম পোলা-মাইয়া রিকশাত লইবেন না।"
"কেরে?"
"এমনেই।"
"আইচ্ছা লমু না।"
"জানস বউ, অহন আমার কি ইচ্ছা করতাছে?"
"কি ইচ্ছা করতাছে আপনের?"
"ইচ্ছা করতাছে আমি তর পাশে বই আর আরকেউ আইসা রিকসাডা চালাক।"
"হি হি হি হি..."
"হাসতাছোস কেরে?"
"আপনের ইচ্ছা করলে আপনে বইবেন। কেউ কি মানা করছে নাকি?"
"তাইলে রিকশা চালাইব কেডা?"
"আমি ক্যামনে কমু?"
"খাড়া, টুনু মিয়ার দোহানে যাই। অইহানে গিয়া তুই-আমি একলগে চা খামু!"
"আইচ্ছা!"
টুনু মিয়ার চায়ের দোকনটা এখান থেকে বেশি দূরে নয়। মিনিট পাঁচেক লাগবে। টুনু মিয়ার দোকানে পৌছে আমি রিকশা সাইড করে রাখলাম। বিকেল বেলার সময়। টুনু মিয়ার দোকানে অনেক ভীড়।
"টুনু মিয়া!! দুইকাপ চা দেও।"
"আরে মতিবাই!! ভালা আছেন? লগে এইডা কেডা? ভাবি নি?"
"হ, তোমার ভাবি।"
"মতিবাই, আপনে রিকশাত যাইয়া ভাবির লগে বন। আমি চা দিতাছি।" টুনু মিয়া এরপর গলা নিচু করে বলল, "বাই, ভাবি কইলাম মেলা সুন্দর।"
"ধুরু মিয়া! কি যে কও না!!"
আমি রিকশায় এসে পুলির পাশে বসলাম। সে ঘাড় ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে আসে পাশে দেখছে। আর কোনদিন বস্তি ছেড়ে এতদূরে আসেনি আগে।
"কিরে ডাহা শহর কিরম লাগতাছে।"
"আপনের লগে রিকশা দিয়া ঘুরতে মজা লাগতাছে।"
"জানস, ডাহা শহরে রিকশা চালাইতে সময় যতবার দেখছি পোলা-মাইয়া একলগে ঘুরতাছে ততবার আমার মনে হইছে কবে তরে লইয়া ঘুরমু!"
"হইছে আর ডং করন লাগত না। বুঝছি আমি..."
"ডং করলাম কই। আমিতো হাচা কতা কইলাম।"
"মতিবাই, এই লও চা। ভাবি ভালা আছেন নি?"
"জ্বে বাই, ভালাই আছি। আপনে ভালা আছেন?"
"টুনু মিয়া, তোমারেতো বিস্কুট দিতে কইনাই। খালি চা দিতে কইছিলাম।"
"মতিবাই, ভাবিরে নিয়া আইছেন। খালি চা ক্যামনে দেই। বিস্কুট আমার পক্ষ থেইক্যা দিলাম। গরীব মানুষ, এরচেয়ে ভাল কিছু দিয়া সমাদর করার ক্ষমতা নাই।"
"না, না, বাই। কি যে কন না, আমরাওতো গরীব। আপনে যতটুকু করছেন তাতেই আমরা অনেক খুশি হইছি।"-পুলি তাড়াতাড়ি বলে উঠল।
"ভাবী আমি যাই। কাস্টমার খাড়াইয়া রইছে।"
টুনু মিয়া বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমরা বেশিক্ষন দেরি করলাম না। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। চা খেয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। টুনু মিয়া কিছুতেই চায়ের টাকা নিল না। আমিও বেশি জোড়াজুড়ি করলাম না। আরেকদিন টুনু মিয়ারে ফ্রি একটি ট্রিপ দিলেই হবে।
বস্তির গলির মুখের কাছাকাছি আসতেই সামনে দেখলাম চার-পাঁচটা ছেলে একটা প্রাইভেট কারকে ঘিরে রেখেছে। একজনের হাতে চাকু। অন্যদের হাতে বাঁশের লাঠি। ড্রাইভারটা অল্পবয়স্ক। ভয়ে চেহাড়া সাদা হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ করে টায়ারের কর্কশ শব্দে আমার গা রি রি করে উঠল। গাড়ির সামনে থাকা ছেলেগুলা ছিটকে রাস্তা উপর পড়ে গেল। আমি সর্বশক্তিদিয়ে চেষ্টা করলাম গলির ভিতর ঢুকে যেতে। রিকশার মাথাটা গলিয়ে দিয়েছি এমন সময় কারটা আমার রিকশার পিছনদিকে আঘাত করল।
এরপর কি হল বলতে পারব না। শুধু পুলির চিৎকার শুনলাম আর সারা দুনিয়া যেন আমার চোখের সামনে ঘুরতে লাগল। চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। বহু কষ্টে উঠে বসলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি রক্তাক্ত একটা মাংসপিন্ড পড়ে আছে।
এটা কি আমার পুলি??!!
জানি না। তবুও তাকে বুকে জড়িয়ে বসে রইলাম। সমগ্র সত্ত্বা বেধ করে চিৎকার করতে চাইলাম। গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। মূর্তির মত বসে রইলাম আমার দোমড়ানে মোচড়ানো প্রেমিকার পাশে আমার বউকে নিয়ে!
No comments:
Post a Comment