Featured Post

I SAID NO TO QUANTUM METHOD

পূর্বে পোস্ট আকারে প্রকাশিত। কারও সাথে ঝগড়া করার জন্য এটা দেইনি। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। কেউ মানতে না পারলে আমার কিছু করার নেই।  আ...

Monday, October 13, 2014

ছেলে ও মেয়ের গল্প

১. স্থান ঢাকা, বইমেলা-২০১৪। রমনার এক গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে ঢুকব। প্রচন্ড ভীড়। আরো আগেই কেন ঢুকিনি সেটাই ভাবছিলাম। এই ভীড়ের মধ্যে পড়লে হাটা লাগবে না। এমনিতেই ঢুকে যাওয়া যাবে। সাথের বড়ভাই বললেন, সবাই একসাথে ঢোকা যাবে না। বিচ্ছিন্ন হওয়াই লাগবে। যার যার মত ঢোক। তারপর লেখক মিলনায়তনের সামনে দাড়ালেই হবে। বলেই মুহূর্তের মধ্যেই উনি হারিয়ে গেলেন। আমিও ফুটপাট থেকে মেইন রোডে নামলাম। নামতেই একটা চিৎকার শুনলাম। বকের মত গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কি হয়েছে। দেখলাম মধ্যবয়সী একলোককে তার চেয়ে কমবয়সী এক লোক সমানে ঘুষি মারছে। মধ্যবয়সী লোকটা পড়নে পাঞ্জাবী, মুখে কয়েকটা দাড়ি। ঘুসি আর টানা-হেচড়ার চোটে তার টুপি-স্যান্ডেল ছিটকে একদিকে চলে গেছে।

"মাদার**, ভীড়ের মধ্যে এইগুলাই করছ?"-বলেই আরেকদফা ঘুষি।
"ভাই, আমারে মাফ কইরা দেন। আর জীবনেও করুম না।"

তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে সামনে পা বাড়ালাম। যতই গেটের মুখের দিকে আগাচ্ছি ভীড়ের চাপ ক্রমেই বাড়ছিল। আমার সামনে একটা হিন্দু ফ্যামিলি। লোকটা তার পিচ্চিটাকে কোলে নিয়েছে আর মহিলা তার গা ঘেষেই আছে। হারিয়ে গেলে মুশকিল। ভীড়ের চাপ সহ্য করতে না পেরে মহিলা কঁকাতে লাগলেন। একটু পর পিছন ফিরে বলে ফেললেন,

"ভাই চাপ দিয়েন না।"

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খেয়াল করতে লাগলাম। কেউ কি তার গায়ে হাত দিছে? তেমন কিছু চোখে পড়ল না। ডানদিকে ফিরে দেখলাম রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টে দাঁড়িয়ে এক পুলিশ একহাতে ল্যাম্পপোস্ট ধরে আরেক হাতের লাঠি দিয়ে কয়েকটা ছেলেকে দমাদক কয়েক ঘা লাগিয়ে দিল। আর মুখের গালিগালাজ তো আছেই।

সামনে আগাচ্ছি আর ঐ হিন্দু মহিলার ককানি বাড়ছে। পারলে কেঁদেই ফেলে। আমার অবস্থাও দোমড়ানো কাগজের মত। দাতে দাত চেপে আছি। হঠাৎ করে পাশে হৈইইইইইই করে একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম। দেখলাম এক ছেলে ১৪-১৫ বছর বয়সী এক মেয়েকে ঠেলে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটি কি করছিল সেটা লিখলে চটি পোস্ট হয়ে যাবে। চটি লেখা আমার উদ্দেশ্য না। মজার ব্যাপার হল এই মেয়েটি চুপ করেছিল। ভয়ে না বিস্ময়ে-কে জানে? যাইহোক, একসময় গেট ক্রস করলাম।

২. মুন্নি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে বেশিদিন হয়নি। সংসারের বড় মেয়ে। প্রায়ই নানান কাছে বাইরে যেতে হয়। নিজেদের গাড়ি যেহেতু নেই, পাবলিক গাড়িতেই চড়তে হয়। গাড়িতে চড়তে মুন্নি কোন অসুবিধা নেই। অসুবিধা হয় গাড়িতে চড়ার পর। সে একটা মেয়ে, এটাই তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। একটু গায়ে গা ঘষা দিতে চায়। মুন্নি সরে বসে। এতে তার পাশের লোকটা আরো মজা পেয়ে যায়। লোকটা মুন্নির দিকে আরো সরে আসে। মুন্নির মাথায় আগুন ধরে যায়। সে আস্তে করে তার সাথের ব্যাগটা খুলে পেন্সিল আর শার্পনার বের করে পেন্সিল শার্প করতে থাকে লোকটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে। এবার কাজ হয়। লোকটা আস্তে করে করে বসে।

৩. কাকা আর ফুপাত ভাইয়ের সাথে শিউলী বাইরে যাবে। টেম্পুতে উঠল। টেম্পুতে সাধারনত সাইডের দিকে সিটে দরজার সাথে মেয়েদের বসার জায়গা দেয়া হয়। তারা যে টেম্পুতে চড়েছিল ওটাতে সাইড সিটে একটি সিটই ছিল। শিউলী সেটাতে বসল আর তার কাকা-ভাই ভিতরের দিকে বসল। শিউলী একটু পরেই বুঝল তার পাশের লোকটা বদ। লোকটা শিউলীর পিছন দিক থেকে হাত দিয়ে টেম্পুর রড ধরল যেন সে ব্যালেন্স রাখার চেষ্টা করছে। শিউলী কড়া গলায় বলল,

"হাত সামনে দেন। সামনে রড আছে না? ঐটাতে ধরেন।"
"আরে আমার হাত আপনার গায়ে লাগবে না।"
"লাগবে কি লাগবে না, সেটা পরে। হাত সামনে আনতে বলেছি, আনেন।"

শিউলীর কথা শুনে তার কাকা-ভাইয়া সহ টেম্পুর যাত্রীরাও ঐ লোকটার উপর ক্ষেপে গেল। পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ভেবে লোকটাও আর কথা বাড়ল না। সুবোধ বালকের মত বসল।

৪. স্থান সিলেট। টাউন থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবার জন্য অপেক্ষা করছে ইশতিয়াক । সাথে তার এক বড় ভাই তুষার। দু'জনে ঘুড়তে এসেছে। সকালে দুই মাজার দেখা হয়েছে। এখন বাপ্পি তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে সাস্টে যাচ্ছে। এইফাকে সাস্টও দেখা হয়ে যাবে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে সিএনজি যায় সাস্টে। একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা সিএনজি পাওয়া গেল। প্যাসেঞ্জার মাত্র একজন। একটি মেয়ে পিছনের সিটে বসে আসে। তাদের দু'জনকে দেখে মেয়েটি একটু সরে বসল। মেয়ে দেখে ইশতিয়াক একটু অস্বস্তিবোধ করল। বড়ভাই বুঝতে পেরে নিজেই আগে বসলেন। তারপর ইশতিয়াক একপাশে বসল।

সিএনজি কিছুদূর চলার পর আরো দু'জন প্যাসেঞ্জার পাওয়া গেল। তার সামনে ড্রাইভারের পাশে বসল। একটু এগোনোর পর হঠাৎ ইশতিয়াক খেয়াল করল বড়ভাই তাকে চাপ দিচ্ছেন পাশ থেকে। ইশতিয়াক একটু অবাক হল। না তাকিয়েও বুঝতে পারল বড়ভাই কাঠ হয়ে আছেন। সে আরেকটু চেপে বসল। বড়ভাইও সরে আসলেন। মেয়ে আর বড়ভাইয়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হল। সিএনজি আরো কিছুদূর চলল। আবার বড়ভাই ইশতিয়াককে চাপ দিলেন পাশ থেকে। মেয়ে ভাইয়ের দিকে আরো সরে এসেছে। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝা না গেলেও ভাই যে লজ্জায় আরো শক্ত হয়ে গেছেন তা ভাল করেই বোঝা গেল। একসময় এই বিব্রতকর যাত্রা শেষ হল।

৫. চিটাগাং নিউমার্কেট। প্রখর রোদের মধ্যে সুহান দাঁড়িয়ে আছে। ভার্সিটিতে যাবে। রাইডারের জন্য অপেক্ষা। তারমত আরো কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন যুবতী-মধ্যবয়সী মহিলাও অপেক্ষা করছে। একটু পরেই একটা রাইডার আসল। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল, কে কার আগে উঠতে পারে। এইসব ধাক্কাধাক্কি কখনই সুহানের পছন্দ ছিল না। সে একটু পিছনের পরে রইল। এক সালোয়ার-কামিজ পরিহিত হিন্দু মহিলা গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁক পেলেই ভিতরে ঢুকে যাবে। হুট করে মহিলা নেমে গেল। পিছনের লোকটার দিকে ফিরেই

"ওই খান* **! গায়ে হাত দেছ ক্যান? পিডায়া গায়ের চামড়া তুলে ফেলমু বদমাইশ। রাস্তা-ঘাটে মেয়ে দেখলে হুশ থাকে না? ...(কন্টিনিউ)"

যাকে উদ্দেশ্য করে এই বক্তব্য সে হালকা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল। মহিলা আরো রেগে গেল। এরই ফাকে রাইডার টান দেয়াতে সুহান গাড়িতে উঠে গেল। ঐলোকটাও উঠল। লোকটাকে উঠতে দেখে সুহানের মনে হল বেচারা এইসবের কিছুই জানে না। মহিলা রাস্তার দাঁড়িয়ে গাল পারতেই লাগল। সুহানের ধারনা ভেঙে দিয়ে গাড়ি একশ গজ যেতেই লোকটা নেমে গেল। সে নাকি যাবে না!

৬. নিশা একটা চাকুরী করে। ছোটখাট চাকুরী। তেমন মাইনে পাওয়া যায়। তবুও নিজের হাতখরচটা চলে যায়। লোকাল বাসেই তার যাতায়াত। একদিন যাওয়ার পথে সিট না পেয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর একটা সিট খালি হল। বাসের কন্ট্রাকটর তাকে ডেকে এনে ঐ সিটে বসিয়ে দিল। নিশা বসতেই তার পাশের লোকটা দু'চোখে ঘুম ভেঙে আসল। সে ঘুমের ভাণ করে বার বার তার গায়ে হেলান দিতে লাগল। নিশা আস্তে করে তার পার্স থেকে কাটা কম্পাসটা বের করল। কম্পাসের চোখা মাথাটা কাধের পাশে সেট করল। এরপরের বার হেলান দেয়ার চেষ্টা করতেই শুধু "উহ" করে একটা শব্দ বের হল আর ঘুম বাবাজি কোথায় যে পালালো-আর খুজেই পাওয়া গেল না।

৭. মেহেদীর বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনেক দূর। ভেঙে ভেঙে যেতে হয়। সিএনজি থেকে নামার পর লোকাল বাসে উঠতেই কন্ট্রাকটর বলল ভাই পিছে যান। সিট খালি। পিছনে যেয়ে দেখে একেবার পিছনের সাড়ির পাচসিটের মধ্যের মাঝেরটা খালি। বাকি চারসিটের মানুষগুলো এমন যে এতটুকু জায়গা আছে। মাঝের সিটের একপাশে এক সুন্দরী মহিলা দেখে মেহেদী থমকে দাড়াল। সাদা শাড়ী, বালা, কপালে লাল টিপে হিন্দু মেয়েটিকে অনেক সুন্দর লাগছিল। মনেহয় কোন প্রাইমারী স্কুলে সদ্য চাকুরী নিয়েছে। মেহেদীকে দেখে মেয়েটি একটু চেপে বসল যেন মেহেদী বসতে পারে। তাও যে জায়গাটুকু হয়েছে সেখানে বসলে মেয়ের গায়ের সাথে মেহেদীর গা যে মিশবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মেহেদীর আবার আত্নসম্মানবোধ প্রবল। কোন মেয়ের গায়ে গা ঘেষে বসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।

মেহেদী দাঁড়িয়ে থাকাই মনস্থ করল। একটু পর কন্ট্রাকটর এসে বলল,
"ভাই এখানে বসেন। দিদি চাইপা বসেন।"
"উনি এখানে না বসলে আমি কি করব।"- মেয়েটি জবাব দিল।
"আমার বসতে হবে না। আমি এখানে ভাল আছি।" - মেহেদী ছোট্ট করে জবাব দিল।
৮.  আজ প্রচন্ড গরম পড়েছে। আর রাইডার ভিতরে গরম আরো বেশি। দরজার সাথে ঢুকতেই হাতের ডানের সিঙ্গেল সিটে তামান্না বসে আছে। গরমে দরদর করে ঘামছে। আজ মানুষও বেশি। একজন নামলে দু'জন উঠছে। উঠতে-নামতে তামান্নার গায়ে একটা করে ইচ্ছেই হোক বা অনিচ্ছায় হোক ঘষা দিয়ে উঠছে-নামছে। তামান্না বুঝতে পারে কে কে ইচ্ছেই করছে আর কে অনিচ্ছায়। পুরুষদের প্রতি তার অদ্ভূত এক বিতৃষ্ণা তৈরি হল নিজের মধ্যে।

পিছনের সিটে বসে সমস্তই দেখছিল বাপ্পি। দেখছিল মেয়েটা কিভাবে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে বাসের দেয়ালের সাথে সিটের সাথে মিশে যাচ্ছিল! কি ভেবে বাপ্পি গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। তারপর সবাইকে ঠেলে মেয়েটির পাশে যেয়ে দাড়াল। বাহাতে মেয়েটির সিটের লোহার রড ধরল, ডানহাতে ধরল সামনের দরজার সাথের রড। এর ফলে তামান্নার পাশে একটা মানব প্রাচীর তৈরি হল। তামান্না অবাক হয়ে বাপ্পিকে একপলক দেখল। বাপ্পি অবশ্য তামান্নাকে বেশিক্ষন গার্ড দিতে পারল না। তার নামার সময় হতে নেমে গেল।

বাপ্পি নামার পর তামান্নার মনে হল, আরে! ভাইয়াটাকে তো একটা ধন্যবাদও দেয়া হয়নি। তামান্নার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

এমন ঘটনা সবারই কমবেশি জানা আছে। আমাদের চারপাশেই ঘটছে এই ঘটনা গুলো। আমাদের নিয়েই ঘটছে। তবুও আমি বলতে চাই একজন মানুষ যদি বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিন বাইরে যায় তবে ২০০ দিন এই ধরনের পরিস্থিতে তাকে পড়তে হয় না। হয়ত ২-৩-৪ দিন পড়তে হয়। বাসের ৪০-৫০ জনের সবাই কিন্তু এমন আচরণ করে না। করে ২-১ জন। সমাজের মানুষগুলো এখনো পচে যায় নি। সমাজ এখনো পচে যায় নি। ভালমানুষের, নিরপেক্ষ মানুষের সংখ্যাই বেশি।

ভালবাসুন, সম্মান করুন। প্রতিদান পাবার আশা না করেই। কিন্তু প্রতিদান এত বেশি পাওয়া যায় যে তখন নিজের ভালবাসাটুকু খুবই সামান্য মনেহয়। পৃথিবী সুন্দর মনে হয়। বেচে থাকতে ইচ্ছে জাগে।
গুডলাক!

No comments: