টুট টুট টুট! টুট টুট টুট!
বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে গেল। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে এলার্ম অফ করলাম। রাত তিনটা বাজে! এত রাতে কেউ এলার্ম দিয়ে রাখে? আমি দিয়ে রাখি। যাদের আমার মত পাগলামী করতে ইচ্ছে করে তারাও নিশ্চয়ই দিয়ে রাখে।
ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামলাম যেন কোন শব্দ না হয়। ওয়াশরুমে যেয়ে ফ্রেশ হলাম। আজ পূর্ণিমা ছিল। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে রাস্তার হলুদ আলো ছাড়াও নীল জোছনা আসছে। পর্দাটা আরেকেটু ফাঁক করে দিলাম। মুহূর্তেই আলোতে বিছানা ভেসে গেল। অবশ্য বিছানায় আগেই চাঁদের চেয়েও সুন্দর একটা পরী শুয়ে আছে।
আমার বকুল!
ওর শুয়ে থাকার ভঙ্গিটা একেবারেই বাচ্চাদের মত। মায়ের পেতে পেটে বাচ্চা যেভাবে থাকে ঠিক সেভাবে। গুটিসুটি মেরে আছে। হাতদুটো মাথার পাশে ভাঁজ করা, পাদুটো ভাঁজ হয়ে প্রায় বুকের কাছাকাছি চলে এসেছে। সবকিছ ছাপিয়ে আমার চোখ গিয়ে পড়ল বকুলের ঠোটের নিচের লাল তিলটার উপর। আমি কি ঐ তিলটা একটু ছুঁয়ে দেব? যদি ঘুম ভেঙে যায়? আমি আলতো করে ছুয়ে দিলাম। ঘুমের মধ্যে ওর ঠোটটা একটু কুঁচকে গেল। আমি হাত সরিয়ে নিলাম।
বকুল আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। আব্বু-আম্মুর সাথে প্রথমবার যখন দাদু বাড়ি যাই তখন দেখা হয়। আমার অবশ্য ঝাপসা ঝাপসা মনে আছে। অনেক আগের কথা কিনা। শুধু মনে পড়ে আমি বাড়িতে গেলে পাড়ার সব ছেলে-পেলে আমার সাথে থাকত। বকুলও তাদের মধ্যে একজন। শুধু পার্থক্য ছিল, ও সারাক্ষন আমার সাথে থাকত। আমি যখন খাব, ও আমার সাথে খাবে-এমন ছিল। ওর বাবা-মা ওকে নিয়ে যেতে চাইলেও ও যেত না। জোড় করলে চিৎকার করে কাঁদত। উপায়ান্তর না দেখে আম্মু ওকে নিয়ে যেতে বারণ করতেন। আম্মুকে আমাকে গোসল করিয়ে ওকেও গোসল করিয়ে দিতেন। একই প্লেট থেকে আম্মু আমাদের খাইয়ে দিতেন। রাতের বেলা যখন আমাদের বিছানার উপর বকুল ঘুমিয়ে পড়ত তখন ওর আম্মু এসে ওকে নিয়ে যত। আবার সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই ও আমাদের এখানে চলে আসত।
আমাদের কান্ড-কারখানা দেখে বড়রা হাসত। আম্মুতো প্রায়ই বকুলকে বলত,
-তোকে আশিকের সাথে বিয়ে দেব। বিয়ে করবি না আশিককে?
বকুল চোখ বড় বড় করে বলত,
-হ করমু।
-তাহলেতো তুই আমার ছেলের বউ। আমাকে আম্মু বল।
বকুল তখন ভয়ে ভয়ে আম্মু বলত। আম্মু মিস্টি হেসে বকুলকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন।
আমরা যেদিন চলে আসি সদিন বকুল ছলছল চোখে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল। নৌকা যখন ছেড়ে দিল ও হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগল। বকুলের মা শক্ত করে ওকে ধরে রাখলেন। বকুলের কান্না দেখে আমারও চোখে পানি চলে আসল। আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম। আম্মুও থমথমে মুখে ওদের বিদেয় দিলেন।
বকুলের কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। শহুরে জীবনে গ্রামের লোকজনের কথা ক'দিনই বা মনে থাকে! বকুল অবশ্য কখনই আমাকে ভুলেনি। এগুলো পরে আম্মুর কাছে শুনেছি। ও প্রতিদিন সকাল-বিকেল ঘাটে এসে দাঁড়িয়ে থাকত। পরে বড় হলে যখন বুঝতে শিখে তখন ধীরে ধীরে ঘাটে যাওয়া কমিয়ে দেয়। তারপরও মাঝে মাঝেই তাকে নদীর ঘাটে দেখা যেত।
এরপর আমি বাড়িতে যাই অনেকদিন পর। আব্বু-আম্মু মাঝে মাঝে আসলেও আমার পড়াশুনার কারনে যেতে পারিনি। এস.এস.সি পরীক্ষার পর দাদুর পীড়াপীড়াতে আবার আমরা সবাই মিলে বাড়িতে যাই। আমারও অবশ্য যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। অখন্ড অবসর। গেলে ভালই লাগবে ভেবে আমিও আম্মুর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকি।
ততদিনে গ্রামের দৃশ্যপট অনেক পরিবর্তিন হয়ে গিয়েছে। তাগের মত নৌকা পাড় হতে হয় না। নদীর উপর সেতু হয়েছে। সবুজ ধানক্ষেতের মধ্যে বিদ্যুতের খুটিগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আগের ধূলোময় রাস্তা কালো পিচের নিচে ঢেকে গিয়েছে। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে দু'একটা পাকা বাড়িও চোখে পড়ল।
আমাকে দেখে দাদু খুব খুশি হলেন। আমি এসেছি এই খবর ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। কিছুক্ষনের মধ্যেই চাচা-চাচী, কাজিনদের ভীড় হয়ে গেল ঘরের মধ্যে। আমার ছোটবেলার বন্ধুরাও এসে দেখা করে গেল। একটু পরেও আমি ওদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হলাম। হঠাৎই একটু দূরে দু'টি ঘরের মাঝখানে লাল সালোয়ার-কামিজ পড়া এক মেয়েকে দেখতে পেলাম। এদিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই চট করে আড়ালে চলে গেল। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর এক ফাঁকে আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম-
"আম্মু, একটা মেয়েকে দেখলাম। ও কে?"
"কোন মেয়েটা?"
"ঐ যে লাল জামা পড়া মেয়েটা..."
"ও, আরে ওতো বকুল...কেন তোর মনে নেই?"
"কি বলছ তুমি? বকুল এত বড় হল কবে?"
"ধূর বোকাছেলে। তুইওতো বড় হয়ে গিয়েছিস।"
এরপর আমি সুযোগ খুজতে লাগলাম কিভাবে বকুলের সাথে কথা বলা যায়। আমি খেয়াল করতাম ও আমার আশেপাশেই আছে। কিন্তু সামনে আসত না। চোখাচোখি হলেই কোথায় হারিয়ে যেত। আমিও ছাড়ার পাত্র নই। একদিন ঠিকই ওকে পেয়ে গেলাম।
ওদের বাড়ির নলকূপ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ও আমাদের বাড়িতে কলসী নিয়ে আসল পানি নিতে। পানি ভরে ফেরার পথে আমি ওর পথরোধ করলাম।
"এই দাড়াও!!"
"কি?"
"তুমি আমাকে চেন না?"
"চিনি..."
"তাহলে এমন কর কেন?"
"কেমন করি?"
"এই যে পালিয়ে পালিয়ে থাক। আমি আসার পরে সবাই আমার সাথে দেখা করেছে। তুমি করনি....."
"আমার কথা কি কারো মনে আছে?"-বকুলের গলায় কি একটু অভিমানের সুর?
"কি বলো? মনে থাকবে না কেন? ছোটবেলায় তুমি-আমি মিলে কত দুষ্টুমি করেছি! আমার সব মনে আছে।"
বকুল এবার সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকাল। মনে হল আমার মাঝে কি যেন খুজল।
আমি বললাম, "বিকেলে নদীর ঘাটে ঘুরতে যাব। তুমিও এসো।"
ও আস্তে করে বলল, "আচ্ছাহ্..." তারপর আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
বিকেল হলে আমি নদীর ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। এখন আর ঘাটে পারাপার নেই। সেতু হওয়াতে এদিক দিয়ে লোক চলাচলও কম। দু'টো নৌকা দেখলাম ঘাটে। এর মধ্যে একটি ভাঙা আর অপরটি ভাঙা না হলেও জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থা।
একটু পড়েই বকুলকে আসতে দেখলাম। হালকা নীল রঙের জামা পড়নে। মাথায় ওড়না টেনে দিয়েছে। দূর থেকেই ওর হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ শুনতে পেলাম। বিকেলের হালকা রোদে ওকে পুরো অপ্সরীর মত লাগছিল। ও কাছে আসতেই আমি ওর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। আমার দৃষ্টি দেখে ও একটু লজ্জাই পেল।
> কি দেখছো?
>> উম্ম্ম...
>আহ! এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
>>না, কিছু না। কেমন আছো তুমি?
>যেমন দেখছো...
>>তুমি অনেক সুন্দর হয়েছো...
>তাইই!! আচ্ছাহ! ......চলো নৌকা দিয়ে ঘুরি।
>নৌকা চালাবে কে? কাউকেই তো দেখছি না।
>আমি চালাবো...
>>তুমি?!! তুমি নৌকা চালাতে পারো?-আমার কন্ঠে নিখাদ বিস্ময়।
>হ্যা পারি। এসোতো।
ও আমার হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে চলল। ওর আচরণে কোন জড়তা নেই। মনেহল, আমরা আবার আগের মত ছোট হয়ে গিয়েছি। ওর স্পর্শে আমার সর্বাঙ্গে ভাললাগার একটা শিহরণ বয়ে গেল। বকুলেরও কি এমন হচ্ছে? ওকে দেখে অবশ্য কিছুই বোঝার উপায় নেই।
একটু ভাল যে নৌকাটি ছিল ঐ নৌকাতে উঠে বসলাম। আমার একটু ভয় ভয় লাগছিল। তারচেয়ে বেশি ছিল ভাললাগা। অন্যরকম এক অনুভূতি হচ্ছিল, যার সাথে আমি পরিচিত নই।
আমাকে বসতে দেখে বকুল ঠেলা দিয়ে নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে বৈঠা চালাতে লাগল।কিছুটা সময় দু'জনেই চুপ।
"তুমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছ।"- বকুলই প্রথম নীরবতা ভাঙল। আমি হাসলাম।
"তুমিওতো হয়েছে। আচ্ছা তুমি এত সুন্দর করে কথা বল কিভাবে? ঠিক শহরের ছেলেপেলেদের মত!"
"আমাদের স্কুলের একজন স্যারের কাছে থেকে শিখেছি। উনি সবসময় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে বলেন। তিনি নিজেও সবসময় তাই করেন।"
"আচ্ছা বকুল, তোমার কি একটি কথা মনে আছে?"
"কোন কথা?"
"ঐ যে ছোটবেলায় আম্মু তোমাকে বলত আমার সাথে বিয়ে দেবে?"- কিভাবে যে কথাটা আমি বলে ফেললাম।
আমার কথা শুনে বকুল একেবারে চুপ হয়ে গেল। আমি প্রমাদ গুনলাম। বকুল কি রাগ করেছে? তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম,
"এতকিছু ভেবে আমি কথাটা বলিনি। তুমি কিছু মনে করো না।"
বকুল চোখ তুলে আমাকে একবার দেখল। একমুহূর্ত পর বলল-
"চলো বাড়ি ফিরে যাই।"
"কেন?"- আমি আহত স্বরে বললাম।
বকুল আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, "বৃষ্টি আসবে।"
বকুলের কথায় আমি আকাশের দিকে তাকালাম। এতক্ষন খেয়ালই করিনি। কালো, গম্ভীর মেঘে আকাশ ছেয়ে গিয়েছে। কান পাততে মেঘের গুড়ুগুড়ু ডাকও শুনতে পেলাম। এত সুন্দর বিকেলটা নষ্ট হয়ে গেল ভেবে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
ছোট্ট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, "আচ্ছাহ্। চলো।"
ইতোমধ্যে বকুল নৌকা ঘুরিয়ে ফেলেছে। তবুও শেষরক্ষা হল না। নৌকা তীড়ে ভীড়তেই বড় বড় ফোঁটা পড়তে লাগল। একটু পরেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দু'জনেই দৌড়ে গিয়ে পাড়ের বকুল ফুলের গাছের নিচে দাঁড়ালাম।
হঠাৎ করে কড়াৎ শব্দে বাজ পড়তে বকুল আমার গায়ের সাথে সেটে এল। আমার বাহু আকড়ে ধরল।
>>কি হল?
>ভয় লাগে। ভীষণ ভয় লাগে।
>>ধূর বোকা। ভয়ের কি আছে। আমি আছিতো।
ও ফিরে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি দেখলাম ভয়ে-ঠান্ডায় ওর ফর্সা চেহাড়া নীলচে হয়ে উঠেছে। ঠোট দু'টো মৃদু কাঁপছে।
এরইমধ্যে আরেকটা বাজ পড়ল। বকুল লাফিয়ে উঠে আমাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। ওর দ্রুতলয়ের হৃদস্পন্দন আমি আমার পাঁজরের মধ্যে অনুভব করলাম। বুঝতে পারলাম এখানে থাকলে ওর ভয় কাটানো যাবে না। তাছাড়া বজ্রপাতের সময় বড় কোন গাছের নিচে থাকাও ঠিক না।
আমি ওর কাধ ধরে জোড় করে ওর বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হলাম।
>>এখানে থাকা যাবে না। চলো বাড়ি যাই। গাছের উপর বাজ পড়লে বিপদ হতে পারে।
>আ আ আমি পারব ন-না।
>>বোকা মেয়ে। কোন ভয় নেই। চলতো। আমি তোমাকে পৌছে দিচ্ছি।
আমি ওকে টানতে টানতে নিয়ে এলাম। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। ওদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ও মনেহল একটু ধাতস্থ হল। হাত ছাড়িয়ে নিল। তারপর বলল-
"এবার তুমি চলে যাও।"
"চলো তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেই।"
"না, লাগবে না। আমি যেতে পারব।"
ওর গলা শুনে বুঝতে পারলাম ও আসলেই যেতে পারবে। মৃদু হেসে বললাম-
"আচ্ছা যাও।"
ওকে পৌছে দিয়ে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই বৃষ্টি ধরে এল। ঠান্ডায় আমি কাঁপছি প্রায়। ঘরে ঢুকেই পড়লাম আম্মুর তোপের মুখে। বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ইচ্ছামত বকা দিলেন। আমি কিছুই বললাম না। ভাললাগার এক ঘোরের মধ্যে আমি চলে গিয়েছিলাম। আগামী একমাস আমাকে কেউ জুতাপেটা করলেও কিছু মনে করতাম না। ভেজা কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পড়ে নিলাম।
সন্ধ্যা হতেই মাথা ভার ভার লাগতে লাগল। বিছানায় বসে ছিলাম। শীত শীত লাগতে শুরু করল। তারপর আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। পড়ে যাবার শব্দ পেয়ে আম্মু দৌড়ে এলেন। ততক্ষনে আমার কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে। চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। তারপর কিভাবে কি হল বলতে পারব না। শুধু মনে আছে, আম্মু উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কে যেন আমার মাথায় পানি ঢালছে। টেকো মাথার একলোক আমার মুখের ভিতর কি যেন ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বকুলের মুখটাও কয়েকবার দেখলাম মনে হল। শুকনো মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে মনেহয় স্বপ্নেই দেখেছি; বকুলের মুখতো এত শুকনো নয়।
তারপর একসময় আমার খুব পানির পিপাসা পেল। দুর্বল গলায় ডেকে উঠলাম,
"আম্মুওও......"
আম্মু আমার পাশেই শুয়ে ছিলেন। আমার ডাকে জেগে উঠে বসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
"কি হয়েছে বাবা?"
"আম্মু, পানি খাব।"
আম্মু উঠে লাইট জ্বালালেন। আলো চোখে পড়তেই আমার চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে এল। আম্মু পানি এনে আমাকে ধরে বসিয়ে দিলেন। তারপর পানির গ্লাসটা আমার মুখের কাছে ধরলেন। আম্মুর হাত থেকে গ্লাস নিয়ে আমি এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু খেয়ে নিলাম। ইতোমধ্যে নড়াচড়ার শব্দে পাশের রুম থেকে আব্বু উঠে এলেন। আমার কপালে হাত দিয়ে আম্মুকে বললেন,
"জ্বরতো কমে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।"
"তাইতো দেখছি।"
"তুমি কিছু খাবে? ফল-টল?"- আব্বু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
"কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। পানি খেলাম, পানিও তেতো লাগল।"-ধীরে ধীরে বললাম।
"আচ্ছা তাহলে এখন ঘুমাও। সকালে খেও।"
বলে আব্বু চলে গেলেন। আম্মুও লাইট নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে চেষ্টা করলাম। ঘুম আসছে না। বকুলের কথা মনে পড়ছে। খানিকক্ষন ইতঃস্তত করে আম্মুকে ডাকলাম মৃদু গলায়-
"আম্মু ঘুমিয়েছো?"
"নারে, আবার পানি খাবি?"
"নাহ্। পানি খাব না। আচ্ছা আম্মু, বকুল কি এসেছিল?"
"হ্যা, এসেছিল। গত তিনদিনে সারাক্ষন তোর মাথায় পানি ঢেলেছে। তোর জ্বর দেখে আমরাতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।"
"কি বল আম্মু!!? আমি তিনদিন ধরে বিছানায়!"
"হ্যা।"
"আমারতো মনে হচ্ছে আজকে সন্ধ্যার ঘটনা।"
"নাহ্। দু'দিন তোর জ্বর না কমায় আজকে বিকেলে তোর আব্বু ডাক্তার নিয়ে এসেছিলেন। তিনি তোকে স্যালাইন দেয়াতে একটু মনে হয় সুস্থ হয়ে উঠেছিল।"
আমি আর কিছু বলছিনা দেখে আম্মু একটু পরে বললেন-
"ঘুমিয়েছিস?"
"না।"
"বকুল মনে হয় তোকে খুব পছন্দ করে, তাইনা?"
আমি চুপ করে রইলাম। আম্মু আবারো বললেন,
"দেখিস উল্টা-পাল্টা কিছু করিস না। তোর আব্বু কিন্তু রাগ করবে।"
"কেন?"
"ওসব তুই বুঝবি না। যা বলেছি মনে রাখিস।"
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। আমার চারপাশটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল।
পৃথিবী, মহাশূন্য নাকি অনেক বিশাল। যার কোন কূল-কিনারা নেই। হাতের নাগালের চাঁদও নাকি অনেক দূরে। এই মুহূর্তে পৃথিবী আমার কাছে খুবই সংকীর্ণ মনে হচ্ছে। আমি মনে করতে চেষ্টা করলাম এমন কি হয়েছে যে আব্বু এমনটা করতে পারে। ছোটবেলায় ওদের ফ্যামিলির সাথে আমাদের সম্পর্কতো ভালই ছিল। এখন এমন কি হল যে, আব্বু ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেবেন না?? একটা ব্যাপার হঠাৎ করেই আমার মনে হল, এবার বাড়ীতে আসার পর বকুলের বাবা-মার সাথে আমরা দেখা হয় নি।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারব না। ঘুম ভাঙল মাথায় কারো হাতের স্পর্শে। আমার চুলের মধ্যে আলতো পরশ। ধীরে ধীরে চোখে মেলে তাকালাম। মলিন একটা মুখ চোখে পড়ল। চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। আমি দুর্বল গলায় বললাম,
"একি অবস্থা তোমার?"
"আমার অবস্থার কথা বাদ দাও। তোমার তোমার কেমন লাগছে, তাই বল।"
"আমি মনে হয় ভালই আছি। প্রচন্ড ক্ষুদা লেগেছে।"
"ক্ষুদা লেগেছে? দাড়া তোর খাবার ব্যবস্থা করছি।" আম্মু কখন ঘরে ঢুকেছেন টের পাইনি। আম্মু আমার মাথায় হাত দিয়ে আবার পাশের রুমে চলে গেলেন। আম্মুর পিছু পিছু বকুলও চলে গেল। একটু পরেই বালতি আর পানির মগ দিয়ে গেল। আমি উঠে বসলাম। পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। এরমধ্যে বকুল গামছা নিয়ে এসেছ। আমি হাত মুখ ধুয়ে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসলাম। বকুল আমার পায়ের কাছে বসল।
"তোমাকে দেখতে একেবার পেত্নীর মত লাগছে।"
"আর তোমাকে দেখতে লাগছে একেবার ভূতের মত।"
এরপর দু'জনে হেসে উঠলাম। আম্মু আপেল, কমলা, শরবত নিয়ে এলেন।
"আম্মু, আব্বু কোথায়?"
"তোর আব্বু হাটে গিয়েছে। তোর জন্য কবুতের বাচ্চা নিয়ে আসবে।"
বলেই আম্মু চলে গেলেন। আমি শরবত খেলাম, তারপর আপের হাতে নিলাম। বকুল কমলা নিয়ে ছিলতে লাগল।
"তোমার আব্বু-আম্মু কোথায়?"
"ওনারা বাড়িতেই আছেন।"
"তাদের সাথেতো দেখা হল না........."
বকুল চুপ করে থাকল। একমনে কমলা ছিলছে। আমি ধীরে ধীরে আপেল চিবুচ্ছি আর ওকে লক্ষ্য করছি।
আমার হঠাৎ মনে পড়ল কিছুদিন আগে আমাদের বাড়ীতে জমি নিয়ে কি যেন ঝামেলা চলছিল। আব্বু এসে তখন দু'দিন থেকে ছিলেন। তাহলে কি......?
>কি ভাবছো?
>উম্ম...না কিছু না।
>নাও, কমলা নাও।
আমি ওর হাত থেকে কমলা নিয়ে মুখে পুড়লাম। তারপর আরেকটা কোয়া তুলে নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরলাম। বকুল অদ্ভূত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কোয়াটা মুখে নিল।
বিকেল বেলা আব্বু বললেন, দু'দিন পরে যদি আমার শরীর একটু সুস্থ হয় তবে আমরা ঢাকা চলে যাব। আম্মু আর বকুলের তদারকিকে আমি খুব দ্রুতই প্রাণশক্তি ফিরে পাচ্ছিলাম। আর জ্বরটাও আর আসেনি। পরেরদিন আর ঘরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না। শুয়ে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। বিকেল বেলা ধীরে ধীরে হাটতে হাটতে নদীর পাড়ে চলে এলাম। হালকা বাতাস দিচ্ছে। শরীরটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। বসে বসে নদীর ঢেউ দেখতে লাগলাম। কতক্ষন এভাবে বসে ছিলাম বলতে পারব না। হঠাৎ বকুলের গলা শুনে চমকে গেলাম।
"তুমি এখানে কি করো?"
ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম, "এইতো, কিছু না। বসে আছি।"
বকুল আমার পাশে বসল।
"তোমরা কি আগামীকাল চলে যাবে?"
"হুম, আব্বুতো তাই বলল।"
এরপর যেন আমাদের দু'জনেরই কথা ফুরিয়ে গেল। নীরবতা যখন অসহ্য হয়ে উঠল তখন আমি বললাম,
"চলো যাই।"
আমরা উঠে দাড়ালাম। পাশাপাশি হাটতে হাটতে যখন বাড়ীর কাছা কাছি চলে আসলাম তখন বকুল খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরল।
"তুমি কি আমাকে ভুলে যাবে?"
আমি থমকে দাড়ালাম। আসলেই তো, আমি কি ওকে ভুলে যাব? আমি কিছু বলছিনা দেখে বকুল ওর ওড়না থেকে কি একটা বের করে আমার হাতে গুঁজে দিল। তারপর একদৌড়ে চলে গেল।
একটা বকুল ফুলের মালা হাতে নিয়ে আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম।
এবার আমি আর বকুলকে ভুলে যেতে পারলাম না। বরং আমার পুরো পৃথিবীটাই বকুলময় হয় উঠল। বকুল আমার মাথার ভিতর ঢুকে গেল। যেদিক তাকাই বকুলকে দেখতে পাই। কলেজে ভর্তি হয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। একেকটা মেয়েকে দেখি আর আমার চোখের সামনে বকুলের ছবি ভেসে উঠে। আচ্ছা, ওর হাসির সাথেতো বকুলের হাসির মিল আছে...আরেহ! মেয়েটাতো বকুলের মত হাটে! এই মেয়েটা বকুলের মত করে কথা বলে। ঐ মেয়েটার চোখ বকুলের মত। ঐ মেয়েটার.........
যদিকে দেখি দেখতেই থাকি। স্যার ব্ল্যাক বোর্ডে অংক করাচ্ছেন। অংকগুলো ঘুরে ফিরে বকুলের ছবি হয়ে যায়। আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসে। আমি দেখতে পাই বকুল আমাদের ম্যাডাম হয়ে ফিজিক্সের ক্লাস নিচ্ছে। আমার মতো অমনোযোগীর ছাত্রের দিকে চশমার উপর দিয়ে পিট পিট করে তাকাচ্ছে। হাইবেঞ্চে আমি কলম ঘুরাতে থাকি। ধীরে ধীরে সেখানে একটা মেয়ের অবয়ব ফুটে উঠে।
আমার বন্ধুরা আমার কার্যকলাপ দেখে অবাক হয়। আমি নাকি পার্বতীকে ছাড়াই দেবদাস হয়ে যাচ্ছি! খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাকে প্রায় মোরব্বা বানানোর জোগাড়। আমি অতি সাবধানে ওদেরকে এড়িয়ে যাই।
এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। রাতগুলো যেন কাটতেই চাইত না। কি এক অস্থিরতা আমাকে চেপে বসত। বইয়ের পাতায় মন বসত না। বিছানায় শুলে ঘুম আসত না। আমার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে লাগল। রোগা হয়ে যেতে লাগলাম। পূর্ণিমার চাঁদ আমাকে সম্মোহিত করত। আমি হা করে চাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম কেউ আমার মত করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে? চাঁদের বুকে আমার ছায়া খুজতে চাইছে যেমন করে আমি তার ছায়া খুজতে চাইছি?
আম্মু আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতেন। কিছু বলতেন না।
একদিন টিভির সামনে বসে চা খাচ্ছি। কোন চ্যানেলেই ভাল কিছু দেখাচ্ছে না। চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। তারপর কোন এক চ্যানেলে দেখলাম নাটক দেখাচ্ছে। সুমাইয়া সুমি আর মোশাররক করিমের নাটক। তারা দু'জন নদীর ধারে পাশাপাশি বসে গল্প করছে। এটাই একমনে দেখতে লাগলাম।
আরেহ! কোথায় শিমু! এতো বকুল! কোথায় মোশাররফ করিম! টিভিতেতো আমাকে দেখা যাচ্ছে! কি সুন্দর আমরা হাত ধরে হাটছি, গল্প করছি।
"এই তোর কি হয়েছে রে?"
চোখ পিট পিট করে তাকাতেই আম্মুর বিস্ময়মাখা মুখ দেখতে পেলাম। আমি অপ্রস্তত হয়ে গেলাম।
"কই, কিছু নাতো। আমার আবার কি হবে?"
"চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছিস কেন? চুমুক দে।"
তাইতো, তাড়াতাড়ি চুমুক দিলাম। চা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।
"আম্মু, চা-তো ঠান্ডা হয়ে গেল।"
"ঠান্ডা হবে না? চা নিয়ে গাধার মত বসে থাকলে কি চা গরম থাকে?"
আমি হেসে ফেললাম। রাগলে আম্মুকে অনেক কিউট লাগে। আমার হাসি দেখে আম্মু আর গম্ভীর থাকতে পারলেন না। আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-
"তোর কি হয়েছে বলতো? সারাদিন দেখি গম্ভীর হয়ে থাকিস? কি যেন ভাবিস। আগের মত বাইরে বেড়োতে দেখি না। লেখাপড়াতে মনোযোগ নেই। এমন হলে চলবে?"
"আমার কিছু হয়নিতো আম্মু, আমি ঠিক আছি। চিন্তা করো না। আমি ভাল আছি।"
খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে কথাগুলো বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গলায় তেমন জোড় পেলাম না। আম্মু আমার কোন কথা বিশ্বাস করেছেন বলে মনে হল না। কিন্তু আর কিছু জানতে চাইলেন না। উঠে রান্না ঘরের দিকে গেলেন।
আমার ছটফটানির যন্ত্রণা কেউ বুঝতে পারবে না। হাসবে। তাই কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। ভুল হয়েছে! বড় ভুল হয়েছে! বকুলের ঠিকানা নিয়ে আসার দরকার ছিল। তাহলে চিঠি লেখা যেত। অবশ্য এখনো ঠিকানা জোগাড় করা যায়। কিন্তু চিঠি লিখলে সেই চিঠি যে সরাসরি বকুলের হাতে পৌছাবে তার নিশ্চয়তা কে দেবে? অন্যকারো হাতে পড়লে কি ভাববে? বকুলের বদনাম হবে। থাক, আমার জন্য বকুলের বদনাম হয়েছে-এটা সহ্য করার চেয়ে এই ছটফটানিটাই নাহয় সহ্য করলাম। আমি শক্ত হাতে মনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে লাগলাম।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল দু' মাস পরেই আমার ফাইনাল পরীক্ষা। একদিন রাতে পড়ছিলাম, আব্বু এসে আমার রুমে ঢুকলেন।
"আশিক পড়ছো?"
"জ্বী, আব্বু।"
"তোমার পরীক্ষা যেন কবে?"
"এইতো, আর দু'মাস বাকি।"
"কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?"
"কোন সমস্যা হচ্ছে না। সমস্যা হবে কেন?"
"আচ্ছা। তোমার নামে আমার অফিসের ঠিকানায় চিঠি এসেছে।"-আব্বু যেন বোমা ফাটালেন।
"কি এসেছে?"-আমি প্রথমে বুঝতেই পারলাম না।
"চিঠি এসেছে। এই নাও।"
বলেই আব্বু চিঠিটা টেবিলে রেখে চলে গেলেন। আমি অবাক হয়ে চিঠির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কে আমাকে চিঠি লিখতে পারে? ভেবে পেলাম না। তাহলে কি.........?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দুরু দুরু বুকে হলুদ রঙের খামটা হাতে নিলাম। খামের উপর দিয়ে চিঠির ভেতরে নরম,উচু-নিচু কিসের যেন স্পর্শ পেলাম। চিঠিটা এক পাশ থেকে ছিড়ে ফেললাম। তারপর ডানহাতের উপর উপুর করে ধরলাম। আমার আশংকা সত্য প্রমাণ করে হাতের তালুর উপর গড়িয়ে পড়ল ছোট ছোট হালকা হলুদ রঙের বকুল ফুল।
কাঁপাকাঁপা হাতে খামের ভিতর থেকে চিঠির কাগজ বের করলাম। তারপর ভাজ খুলে পড়তে লাগলাম।
"কেমন করে পারলে তুমি এতটা নিঠুর হতে?
আমায় ভুলে যেতে?
আমার যে দিন-রজনী যাচ্ছে কেঁদে, কেটে।"
কেমন আছো? তোমাকে লেখার কোন ইচ্ছা ছিল না। যে আমার কথা একটুও মনে রাখেনি তার কাছে চিঠি লিখে কি হবে? তবুও মনকে বোঝাতে পারিনি। আমিযে একান্তই অসহায় গ্রামের সহজে-সরল একটি মেয়ে। তোমাদের মত শহুরে মানুষদের চিঠি লিখে বিরক্ত করার মত দুঃসাহস করে ফেলেছি। পারলে এই অভাগী মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিও।
অনেক কষ্টে তোমার ঠিকানা জোগাড় করেছি। রাতে যখন বাবা ঘুমিয়ে ছিল তখন তার কাগজপত্র ঘেটে ঠিকানা বের করেছি। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে খুব খারাপ ভাবছ? আসলেইতো, আমি অনেক খারাপ। মানুষ কত সহজেই সবকিছু ভুলে যায়। অথচ আমি পারি না। প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে স্মৃতিগুলো তাড়া করে ফেরে। ঘরের উঠোন পেরোলেও চোখে পড়ে সেই চেনা পথ, সেই পুরনো নদী, নদীর পাড়ে সেই বকুল গাছ...... কিভাবে ভুলে যাব বল? যদি পারতাম তবে এমন কোথাও চলে যেতাম যেখানে এগুলো নেই। তাহলে হয়ত তোমার মত সবকিছু ভুলে যেতে পারতাম!
অনেক ফালতু কথা বলেছি। তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো? ঠিক আছে। তাহলে আসল কথা বলি। জানো, বাবা পাশের গ্রামের মোড়লের ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। সামনের মাসের ২০ তারিখ।
আমি মরে যাবো, তবুও ঐ ছেলের সাথে বিয়ে বসতে পারব না। বিষের একটা ছোট্ট কৌটা কিনে রেখেছি। দরকার হলে......
তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কেন তোমাকে চিঠিটা লিখেছি? আমি...আমি যে তোমাকে...
চিঠি এখানে শেষ। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। টপটপ কয়েকটা ফোটা পড়ল চিঠির উপর।
আম্মুকে ডাক দিলাম। আম্মু এসে আমার অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। আমি আস্তে করে চিঠিটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। ভ্রু কুঁচকে আম্মু চিঠিটা পড়লেন। তারপর প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি আমার হাত তালুতে থাকা ফুলগুলো আম্মার দিকে এগিয়ে দিলাম। আম্মু একপলক দেখেই আমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর মমতা জড়ানো গলায় বললেন,
"কাছে আয় তোকে আদর করে দেই।"
আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আম্মু আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
***********************************************************************************
এরপর আমার দিনগুলো কেমন যেন মলিন হয়ে যেতে লাগল। খাওয়া-দাওয়াও ঠিকমত করতে পারতাম না। দুনিয়ার সবকিছু নীরস ও বিরক্তিকর মনে হতে লাগল। দিনদিন শরীর দুর্বল হয়ে যেতে লাগল। আম্মু খুব বকাবকি করতেন এসব ব্যাপারে। আব্বু এসে দু'একবার আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন। আমি আগ্রহ পেতাম না। শূন্য দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আব্বু দশটা কথা বললে হয়ত একটার জবাব দিতাম।
পরীক্ষার পড়ালেখা শিকোয় উঠল। বই নিয়ে টেবিলে বসে থাকতাম ঠিকই কিন্তু পড়াশুনা কিছুই হত না। দেখা যেত একই পেজ নিয়ে পড়ে আছি ঘন্টার পর ঘন্টা। মাঝে মাঝে শারিরীক দুর্বলতায় ক্লান্ত হয়ে বইয়ের উপরই ঘুমিয়ে পড়তাম। তখন আব্বু এসে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেন।
আমার এহেন অবস্থা দেখে আব্বু-আম্মু খুবই দুঃচিন্তায় পড়ে গেলেন। ডাক্তার এসে আমাকে দেখেও গেলেন। টেনশন ফ্রী থাকতে বললেন। একগাদা ওষুধও দিলেন। আমি বলতে গেলে ওষুধ খেতামই না। কি হবে খেয়ে? একটা খেলে দু'টো ফেলে দেই এমন অবস্থা। আমার অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। আরো দুর্বল হয়ে পড়ছি ধীরে ধীরে।
একদিন সকাল দশটার দিকে ঘুম ভাঙল। আম্মু তখন রান্না ঘরে। আব্বু অফিসে চলে গিয়েছেন আরো আগেই। খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। টেবিলে রাখা জগে পানি নেই। বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিতেই কার্পেটের সাথে পা বেধে গেল। টাল সামলাতে পারলাম না। পড়ে গেলাম। মাথাটা খাটের পায়ার সাথে জোড়সে ঠুকে গেল। তীব্র ব্যথায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল। তারপর আর কিছু মনে নেই।
********************************************************************************
চোখে খুলে সাদা আলোয় কিছুই দেখতে পেলাম না। মাথাটা দপদপ করছে টের পেলাম। চারপাশে ঝাপসা কয়েকটা মুখ আমার উপর ঝুকে আছে বুঝতে পারলাম।
"আশিক!!"-আম্মুর গলা।
"আম্মু, তুমি কোথায়?"
"এইতো আমি বাবা।"-আম্মুর কান্নাজড়িত গলা শুনতে পেলাম।
চোখ কয়েকবার পিটপিট করে দৃষ্টি পরিষ্কার করতে চাইলাম। আস্তে আস্তে সব পরিস্কার হয়ে এল। আমি হাসপাতালে আছি বুঝতে পারলাম।
চশমা পড়া টেকো একজন ডাক্তার আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তারপাশে আম্মু। আব্বু দাঁড়িয়ে আছেন অন্যপাশে। পায়ের দিকে চোখ পড়তেই আমি জমে গেলাম। বকুল দাঁড়িয়ে আছে। আমার দৃষ্টি বকুলের উপর আটকে গেল।
"বাবু, তুমি দেখতে পাচ্ছো?"- ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
আমি আবারো কয়েকবার চোখ পিটপিট করে বললাম, "আমি দেখতে পাচ্ছি।"
"গুড, আর কোন চিন্তা নেই।" ডাক্তার সাহেব আব্বুর দিকে ঘুরে বললেন, "আপনারা টেনশন করবেন না। বিশ্রাম নিলে আর ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করলে কয়েকদিনের মধ্যে ও একদম ফিট হয়ে যাবে।"
বলেই ডাক্তার চলে গেলেন।
আম্মু আমার কাছে এসে আমার কপালে চুমু খেলেন।
"কেমন লাগছে তোর?"
"মাথাটা একটু ব্যথা করছে। তাছাড়া সব তো ঠিকই আছে মনে হচ্ছে।"
আম্মু আমাকে আরেকটা চুমু খেয়ে বললেন,
"তুই শুয়ে থাক। আমরা আসছি।"
বলেই আম্মু আব্বুকে টেনে বের করে নিয়ে গেলেন। আম্মুর প্রতি আবারো কৃতজ্ঞতা অনুভব করলাম।
এবার বকুল এগিয়ে এসে আমার বেডে বসল। ছলছল চোখের আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটু হাসার চেষ্টা করে দুর্বল গলায় বললাম,
"আমি তোমাকে ভুলে যাইনি বকুল।" বুকে হাত দিয়ে বললাম, "এখানে রেখেছি।"
এবার বকুল আমার হাতটা ওর দু'হাতে নিয়ে গালের সাথে চেপে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
*************************************************
বকুল আর আমার বিয়েটা হয়েই গেল। বলা যায় আম্মু আমাদের বিয়েটা করিয়ে দিলেন। ঐ বছর আমার আর পরীক্ষা দেয়া হয় নি। পরের বছর দেই। আম্মু হুমকি দিয়েছিলেন যে পরীক্ষার রেজাল্ট ভাল না হলে উনি নাকি বকুলকে আমার সাথে মিশতে দেবেন না। আমি কি করে তা হতে দেই। আদাজ্বল খেয়ে লেগে গেলাম। রেজাল্টও হল খুব ভাল। আম্মু যতটুকু খুশি হলেন তার চেয়ে বেশি খুশি হলেন আরেকজন। কে বলেনতো???
আমার এক্সিডেন্টের পর আমার মাথার আঘাতটা নাকি গুরুতর ছিল। সাতদিন পর্যন্ত আমাকে আইসিইউ তে রাখা হয়। তারপর একটু ভাল হলে কেবিনে নেয়া হয়। এসময় ঘুমের ঘোরে আমি নাকি প্রায়ই বকুলের নাম ধরে ডেকে উঠতাম। এরপর আম্মু নাকি আর সহ্য করতে পারেন নি। আব্বুকে চিঠিটা দেখিয়ে সবকিছু খুলে বলেন। আব্বু প্রথমে গাইগুই করলেও আম্মুর জিদ ও আমার সংকটাপন্ন অবস্থার কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত বকুলকে নিয়ে আসতে গ্রামে যান। সেখানে দীর্ঘক্ষন বকুলের বাবার সাথে কথা-বার্তা বলতে থাকেন। আমার খবর শুনে বকুলের কান্না দেখে বকুলের বাবাও বেশিক্ষন স্থির থাকতে পারলেন না। বকুলকে আব্বুর সাথে পাঠিয়ে দিলেন। তারাও দু'দিন পরে আমাকে দেখতে ঢাকা আসবেন বলে আব্বুকে কথা দিলেন।
তারপর? তারপর আর কি? সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।
এখন আসল কথায় আসি। আমি এলার্ম দিয়েছিলাম কখন মনে আছে? রাত তিনটায়! এত রাতে এলার্ম দেয়ার কারনটা না শুনেই চলে যাবেন? উহু তাহবে না।
আমি আস্তে করে আবার বিছানায় বকুলের পাশে শুয়ে পড়লাম। তারপর বিছানার পাশে রাখা ছোট টেপ রেকর্ডারটা চালু করে দিলাম। একটু পরেই কড়াৎ করে বজ্রপাত হল!
বকুল একটু নড়ে উঠল। তারপর আবারো বাজ পড়ল। এবার বকুল ধরমড়িয়ে উঠে বসল। আমি যেন কিছুই জানি না এমনি ভঙ্গিতে উঠে ওর পাশে বসলাম।
> কি হলো?
>>কিসের যেন শব্দ হল!
এবার তৃতীয়বারের মত বাজ পড়ল। বকুল শিউরে উঠে আমার হাত চেপে ধরল।
>> মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। বাজ পড়ছে। তুমি শোও। আমি জানাল বন্ধ করে দিয়ে আসি।
> ন-না, না, তুমি কোথাও যাবে না।
এই সময় আবারো বাজ পড়ল। এবার বকুল ভয়ে শক্তভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
আহ! কি শান্তি!!
বকুল যেন টের না পায় এমনিভাবে আমি টেপটা বন্ধ করে দিলাম।
[আমার এই গল্পটা সেইসব ছেলেদের উদ্দেশ্যে লেখা যারা পৃথিবীর সব মেয়েকে একপাল্লায় মাপে এবং যেকোন কারনেই হোক কোন মেয়ের দ্বারা আঘাত পেয়ে এমন ধারণা মনের মধ্যে বদ্ধমূল করে নেয় যে, ভালবাসার ক্ষেত্রে মেয়েদের কোন কমিটমেন্ট /ডেডিকেশন নেই। তারা পারে শুধু অভিনয় করতে আর ভালবাসে শুধু টাকা!]
No comments:
Post a Comment