এক
ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল রিবিন। চারপাশের মৃদু আলোয় সবকিছু ভৌতিক দেখাচ্ছে। যদিও তার যান্ত্রিক চোখে সবকিছুই স্বাভাবিক লাগছে। আলোর কমবেশি তার দেখার কোন পার্থক্য করতে পারে না। আলো বা অন্ধকার তার কাছে সমান। তার চোখের সেন্সর অতি সংবেদনশীল লিথাল লেন্স দিয়ে তৈরি। তার চোখের মত অন্যান্য সবকিছুও খুবই উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। মানব প্রযুক্তিতে নির্মিত সবচেয়ে উন্নত বায়োবট এই রিবিন।
এই মুহূর্তে রিবিন এসব ভাবছে না। সে ভাবছে তার প্রসেসর হুট করে বন্ধ হল কি করে? চট করে কোন কিছু তার যান্ত্রিক ব্রেনে ধরা পড়ল না। সবকিছু স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।
আলট্রা জিরোটু স্পেসশিপটা ঘন্টা খানেক আগেও আলো ঝলমলে ছিল। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আল্ট্রা সিরিজের দুটি স্পেসশীপ বানিয়েছেন। প্রতিটির পিছনে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ করে এই আল্ট্রা জিরো ওয়ান এবং আল্ট্রা জিরোটু দুটি স্পেসশীপ বানিয়েছেন। U আকৃতির এই স্পেসশীপ গুলোর দুই বাহুর মাঝখানে কাচেরমত স্বচ্ছ পদার্থ রিটুনিয়ামের তৈরি সংযোগ টানেল বিদ্যমান। এই টানেলটাই কন্ট্রোল রুম। দেখতে কাচের মত হলেও রিটুনিয়ামের দৃড়তা হীরার কাছাকাছি। অন্তত মজবুত এই কন্ট্রোল রুমের ৫০০ গজের মধ্যে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরন হলেও এর কোন ক্ষতি হবে না। আল্ট্রা সিরিজের স্পেসশিপের আরেকটা বিশেষত্ব হল এর দুই বাহু কন্ট্রোলরুমকে কেন্দ্র করে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে ৩৬০ ডিগ্রী কোনে ঘুরে যেতে পারে। তাই বিরূপ পরিস্থিতিতে এই স্পেসশীপ ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে সোজা উলটো পথে পিছু হটতে পারে। এর ধাতব পৃষ্ঠে সিথিয়ামের বিশেষ কোটিং দেয়া আছে। এই ফলে এই পৃষ্ঠে যেকোন ধরনের রশ্মি ৬০ ভাগ শোষিত হয়।কাজেই লেজারগান, সাউন্ডগান, হিটগান দিয়ে এর কোন ক্ষতি করা সম্ভব হয় না। উপরন্তু সেই শোষিত শক্তি দিয়ে পালটা আক্রমন করা হয়।
এই দুটি স্পেসশীপের একটি মহাকাশে নিরাপত্তা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করে। অপরটি মহাজাগতিক বস্তু এবং প্রাণী নিয়ে গবেষণার কাজে নিয়োজিত। আল্ট্রা জিরোটু হচ্ছে দ্বীতিয় ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনরত স্পেসশীপ। এর অত্যাধুনিক ল্যাব পৃথিবীর যেকোন বায়োলজিস্টের ইর্ষার কারন হতে পারে। পৃথিবীতে প্রাপ্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের সকল নমুনা এতে উপস্থিত। প্রধান কম্পিউটারে সংরক্ষিত রয়েছে এইসব প্রাণী সম্পর্কে প্রাথমিক সবধরনের তথ্য। কারো যদি পাই টু পাই জানার ইচ্ছাও থাকে, তাকেও নিরাশ করবে না সেই কম্পিউটার সাথে সাথে পৃথিবীর ডাটাবেস থেকে তাকে তথ্য সরবরাহ করা হবে।
আল্ট্রা জিরোটু মহাকশে উড্ডয়ণের পরে সফলভাবে প্রথম দু'মাস পৃথিবীর চারপাশে দায়িত্ব পালন করে। এরপর এর জীববিজ্ঞানী জিরোম ও ক্যাপ্টেন সিহান পৃথিবী থেকে সুদূরে দারাউইপ গ্রহের চারপাশে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় আলোর গতিবেগে ছুটলেও দারাউইপ গ্রহে পৌছুতে সময় লাগবে দু'মাস। এই দু'মাস তারা ক্যাপসুলে ঘুমিয়ে কাটাবেন বলে স্থির করা হয়। স্পেসশীপের অপর দুই সদস্য রিশু উইকি এবং লিহা সিনোন। দুইজনেই তারা ইলেক্টিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অসাধারন রেজাল্ট করায় সরকার তাদের আলট্রা জিরোটু তে চাকুরী করার সুযোগ দেয়। তারাও মহাকাশ সম্পর্কে সীমাহীন আগ্রহের কারনে সানন্দেই রাজি হয়ে যায়।
প্রথম পনেরদিন কাটে নিরুত্তাপ। রিবিন সবকিছুই রুটিনমাফিক চেক করে। যদিও সেন্ট্রাল কম্প্যূটার সিসি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে তারপরো ক্যাপ্টেন সিহান রিবিনকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন যেন সবকিছু রুটিনমাফিক চেক করা হয়। আরো কোন ঝামেলা হলে যেন সাথে সাথে তাকে জাগানো হয়।
মহাকাশে সকাল-সন্ধ্যা বলে কিছু নেই। তাই বলা চলে পৃথিবীর হিসেব ষোলতম দিনের সকাল ৭ টায় কম্পিউটারের মনিটরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু ধরা পড়ে। আলোকবিন্দুগুলো দ্রুত আল্ট্রা জিরোটুর দিকে অগ্রসরমান।
+ সিসি, ওগুলো কি?
- মনে হচ্ছে রিটোনদের স্পেসশীপ।
+ বলো কি???
আঁতকে উঠে রিবিন। রিটোনরা কোন মহাজাগতিক প্রাণী নয়। পৃথিবীরই কিছু পথভ্রষ্ট মানুষ। পারমানবিক বোমা ফাটিয়ে পৃথিবীর সবকিছু ধবংস করে নিজেরাই পৃথিবীতে রাজত্ব করতে চেয়েছিল কয়েকশ বছর আগে। তাদের ষড়যন্ত্রের কথা টের পেয়ে তাদের বন্দী করা হয় আর নির্বসনে মহাকাশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কুটিল বুদ্ধিসম্পন্ন রিটোন দলপতি ফাঙ্গাস তাদের বহনকারী স্পেসশীপটি দখল করে নেয়। তারপর তার ক্যাপ্টেন ও ক্রুদের মেরে ফেলে পুরো স্পেসশীপ তার এবং তার অনুগত লোকদের দখলে নিয়ে নেয়। এরপর কাছের স্পেসস্টেশনে মেডে সংকেত পাঠিয়ে সেখানে অবতরন করে সবাইকে মেরে ফেলে সেই স্পেসস্টেশনটাও দখলে নিয়ে নেয়। দখল নিয়ে পৃথিবীর সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পৃথিবী থেকে বহুবার চেষ্টা করেও আর সেই স্টেশনটির পজিশন নির্ধারন করা যায় নি। ফাঙ্গাসের নেতৃত্বে রিটোনরা কালে কালে আরো শক্তি সঞ্চয় করে পেসশীপ ছিনতাইয়ের মাধ্যমে। সুযোগ পেলেই কার্গো স্পেসশীপগুলোর উপর আক্রমণ করে আত্মসমর্পনে বাধ্য করে অথবা ধ্বংস করে দেয়।
সেই রিটোনদের চারটি স্পেসশীপ এখন আল্ট্রা জিরোটুর দিকে এগিয়ে আসছে। ওদের মতলব কি? নিশ্চয়ই ভাল কিছু নয়।
দুই
রিবিন দ্রুত চিন্তা করছে। ক্যাপেন্ট সিহানকে কি জাগিয়ে তুলবে? বায়োক্যাপ্সুলে ঘুমন্ত ক্যাপ্টনকে জাগিয়ে তুলতে সর্বনিম্ন ৫ মিনিট সময় লাগবে। তত সময় কি হাতে পাওয়া যাবে।
-সিসি?
+ রিবিন বলো।
- রিটোন স্পেসশীপ আমাদের কাছাকাছি পৌছুতে কতক্ষন লাগতে পারে?
+ আমার হিসেব বলছে ৩ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড।
- আমাদের স্পীড বাড়িয়ে সময় আরো বাড়ানো যায় না?
+ ক্যাপ্টেন সিহানের অনুমতি ছাড়া সেটা সম্ভব না।
- সিসি বুঝতে চেষ্টা কর। এই মূহুর্তে ক্যাপ্টেন সিহানের অনুমতি নেওয়া সম্ভব না। তার ঘুম ভাঙাতে হলে যে সময় দরকার সেই সময় আমাদের কাছে নেই। তার আগেই রিটোনদের স্পেসশীপ আমাদের কাছে পৌছে যাবে।
+ সেক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই।
রিবিন বুঝতে পারল সিসির সাথে তর্ক করে লাভ নেই। এরমধ্যে মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে। রিবিন দ্রুত স্পেসশীপের শীতল ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। এখানেই বায়োক্যাপ্সুলের মধ্যে মহাকাশযান আলট্রা জিরোটু র অভিযাত্রীরা ঘুমিয়ে আছে। রিবিন দ্রুত ক্যাপ্টেন সিহানের ক্যাপসুলের কাছে যেয়ে "এসকেপ" বাটনে প্রেস করল। মূহুর্তেই কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল। হালকা সাদা গ্যাসে ক্যাপসুলের ভিতরটা ভরে যেতে লাগল। মনিটরে ক্যাপ্টেন সিহানের শারীরিক অবস্থা দেখানো হচ্ছে। ধীরে ধীরে তার পালস বাড়ছে। শরীরের তাপমাত্রা বাড়ছে।
হঠাৎ করে স্পেসশীপের পিছন দিক থেকে দুম করে একটা শব্দ ভেসে আসল। সাথে সাথে স্পেসশীপ একটু কেঁপে উঠল। রিবিন দ্রুত কন্ট্রোল রুমে ফিরে এল।
-সিসি কি হয়েছে?
+ রিটোনরা আমাদের স্পেসশীপকে আক্রমণ করেছে।
বলতে না বলতে আবারো "দুম" এবার আরো জোড়ে, আলট্রা জিরো টু আবারো কেপে উঠল। মনিটরের দিকে তাকিয়ে রিবিন দেখতে পেল রিটোনদের চারটে স্পেসশীপ তাদেরকে ঘিরে ধরেছে।
-সিসি কিছু করো!
+ ক্যাপ্টেনের অনুমতি ছাড়া কিছুই করা সম্ভব নয়।
রিবিন একবার মনিটরের পাশে লাল বাটনটার দিকে তাকাল। ওই বাটনে চাপ দেয়া মাত্র আলট্রা জিরো টুর হাইড্রোওরি টার্বো ইঞ্জিন চালু হবে। এক ঝটকায় অনেকদূর যাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা হল ঐ বাটন চাপ দেয়া আগে নিচের ডিসপ্লেতে সিকিউরিটি কোড প্রবেশ করাতে হবে। ঐ কোড জানা আছে একমাত্র ক্যাপ্টেনের।
এমন সময় যেন 'কড়াৎ' করে বাজ পড়ল। এবার আলট্রা জিরো টু ভয়ংকর ভাবে কেপে উঠল। রিবিন ছিটকে গিয়ে রিটুনিয়ামের তৈরি দেয়ালে ধাক্কা খেল। কন্ট্রোল রুমের আলোটা একবার নিভতে যেয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।
নিজের দুই যান্ত্রিক পায়ের উপর সোজা হতেই কন্ট্রোল রুমের দরজায় ক্যাপ্টেন সিহানকে দেখতে পেল রিবিন। একটু একটু যেন কাপছেন। সম্ভবত গভীর ঘুমের ধাক্কা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেন নি।
+ রিবিন কি হয়েছে?
- সম্ভবত রিটোনরা আমাদের আক্রমণ করেছে। ওদের চারটা স্পেসশীপ আমাদের ঘিরে ফেলেছে। সংক্ষেপে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করল রিবিন।
+ বল কি?
ক্যাপ্টেন সিহান একটু যেন আঁতকে উঠলেন। ইতিমধ্যে রিটোনদের স্পেসশীপ থেকে চারটে হলুদ আলো রিটুনিয়ামের দেয়াল ভেদ করে কন্ট্রোল রুমে প্রবেশ করছে। মহাকাশে হলুদ আলোর অর্থ হল আত্নসমর্পনের নির্দেশ।
- এখন কি হবে ক্যাপ্টেন?
+ সিসি?
=> ইয়েস ক্যাপ্টেন!
+ পালটা আক্রমণ করে ওদের ভয় দেখাও যেন চলে যায়। মহাশূন্যে আমি মানুষ মারতে চাই না।
=> ঠিক আছে ক্যাপ্টেন।
+ যেকোন একটিকে লক্ষ্য করে লেজার গান ছুড়ো। যেন অন্যগুলো ভয় পেয়ে ভেগে যায়।
=> ইয়েস ক্যাপ্টেন।
বলতে না বলতেই বা পাশের সবচেয়ে কাছের স্পেসশীপ লক্ষ্য করে লেজার গান থেকে লেজার ছোড়া হল। ক্যাপ্টেন সিহান অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন স্পেসশীপের পাইলট অদ্ভূত দক্ষতায় লেজারকে পাশ কাটিয়ে গেলেন। সাথে সাথে হলুদ আলো মিটমিট করে উঠেই নিভে গেল। এক সেকেন্ড পড়েই উজ্জ্বল সাদা আলোয় চারদিক ভেসে গেল।
"কড়াৎ, কড়াৎ, কড়াৎ!!!"
প্রচন্ড আক্রমনের তোড়ে পুরো স্পেসশীপ অক্ষের উপর একপাক ঘুরে গেল। কন্ট্রোল রুমের চেয়ার ধরে না থাকলে এবারো রিবিন ছিটকে পড়ত। কিন্তু ক্যাপ্টেন সিহান ঠিকই ছিটকে পড়েছে। দৌড়ে রিবিন ক্যাপ্টেন সিহানের কাছ যেয়ে তাকে সোজা হতে সাহায্য করল। দেয়ালে বাড়ি খেয়ে তার কপাল ইতিমধ্যে ফুলে উঠেছে। সিহানের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
+ রিবিন তুমি এখনই সিট বেল্ট বেধে নাও। আমি ইমারজেন্সি একটিভেট করছি। মনে হচ্ছে ওদের কাছ অত্যাধুনিক কোন অস্ত্র আছে যার সাথে আমরা পরিচিত নই।
- ওকে ক্যাপ্টেন।
মুখে ওকে বললেও রিবিন ক্যাপ্টেন সিহানের হাত ধরে তাকে কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে যেতে সাহায্য করল।
+ সিসি, তুমি রেডি?
=> ইয়েস ক্যাপ্টেন সিহান।
=> ইয়েস ক্যাপ্টেন সিহান।
সিহান এরপর দ্রুত সিকিউরিটি ডিসপ্লেটে কোড দিয়ে লাল বাটন টিপে দিল। গুরুগম্ভীর শব্দে হাইড্রোরিন ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। সাথে সাথে সিসির গলা শোনা গেল।
=> ইমারজেন্সী সাকসেসফুলী একটিভেটেড। রেডি ফর হাইপার ড্রাইভ ইন ফিফটিন সেকেন্ড।
এরই ফাকে রিবিন ও সিহান তাদের চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেল। রিবিন যখন তার সিট বেল্টে হাত দিল তখনি আবার সাদা আলোর ঝলকানি দেখা গেল।
"কড়াৎ, কড়াৎ, কড়াৎ"
"কড়াৎ, কড়াৎ, কড়াৎ"
"কড়াৎ, কড়াৎ, কড়াৎ"
এবার আর রিবিন নিজেকে সামলাতে পারল না। ছিটকে গিয়ে উপরের ছাদের সাথে বাড়ি গেল। তার মাথা ছাদের সাথে জোড়সে ঠুকে গেল। চারপাশটা রিবিনের কাছে কেমন যেন অন্ধকার হয়ে এল।
তিন
এই মুহূর্তে রিবিনের চোখ ক্যাপ্টেন সিহানকে খুজছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ক্যাপ্টেন সিহানকে কন্ট্রোল প্যানেল থেকে প্রায় দশ হাত দূরে পড়ে থাকতে দেখল। জ্ঞান নেই। রিবিন ক্যাপ্টেন সিহানকে পাজকোলা করে তুলে এনে ক্যাপ্টেনের সিটে বসিয়ে দিল। তারপর দেয়াল সংলগ্ন ড্রয়ার থেকে পানির বোতল বের করল। পানি ছিটা মুখে পড়তেই ক্যাপ্টেন সিহানের চোখ কুঁচকে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ দুটো খুলে গেল। চোখের সামনে রিবিনকে ঝুকে থাকতে দেখে ক্যাপ্টেন সিহান মুচকি হাসলেন। দুর্বল গলায় বলে উঠলেন,
+ সব ঠিক আছেতো?
- ইয়েস ক্যাপ্টেন। আপনার শরীর ঠিক আছে। সম্ভবত হাইপার জাম্পের ঝাকুনি সহ্য করতে না পেরে আপনি জ্ঞান হারিয়েছেন।
+ হুম।
রিবিনের সাহায্য নিয়ে ক্যাপ্টেন সিহান ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালেন। চারপাশে এক পলক চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারলেন ইমার্জেন্সী পাওয়ার সাপ্লাই চালু হয়েছে। কোন কারনে মূল পাওয়ার স্টেশন থেকে বিদ্যূৎ পাওয়া যাচ্ছে না।
+ সিসি??
> বলুন ক্যাপ্টেন।
+ চারপাশের অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট করো।
> রিটিনদের আক্রমণ ও হাইপার জাম্পের কারনে আমাদের জেনারেটের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এই কারনে মূল পাওয়ার স্টেশন থেকে পাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া আমাদের কন্টাক্ট এরিয়েলে থেকে কোন সিগন্যাল আসছে না। এ কারনে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
+ স্লিপিং রুমের কি অবস্থা?
> নরমাল পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবার কারনে স্লীপিং রুমে যারা ছিল তাদের জাগানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আগেই। এতক্ষনে তাদের জেগে উঠার কথা।
+ হাইপার জাম্পের পর কতক্ষন সময় অতিবাহিত হয়েছে?
> ২০ মিনিট ২৫ সেকেন্ড।
এরমধ্যেই লিহা, রিশু ও জিরোম কন্ট্রোল প্রবেশ করল। তাদের চোখ-মুখে উৎকন্ঠা।
"কি ব্যাপার ক্যাপ্টেন?"- লিহাই প্রথম প্রশ্ন করল।
ক্যাপ্টেন সিহান সংক্ষেপে সম্পূর্ন পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
"তোমরা ঠিক আছোতো?"
"মাথাটা সামান্য ঝিমঝিম করছে। এছাড়া ঠিকই আছি।" রিশু উত্তর দিলেও বাকি দু'জন 'হ্যা' সূচক মাথা ঝাকাল।
"এবার তাহলে কাজের কথায় আসি।" ক্যাপ্টেন শুরু করলেন। "আমাদের স্পেসশিপের অবস্থা তোমরা দেখতেই পাচ্ছো। পাওয়ার নেই, পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমাদের প্রথম কাজ হবে এই দুটো ব্যাপার চেক করা। রিবিন নিয়ে জিরোম যাক পাওয়ার স্টেশনে। আর তোমরা দু'জন স্পেসশিপের কমিউনিকেশন সিস্টেমটা চেক করে দেখ। চেষ্টা কর পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে। আমি স্কাউটশিপগুলোও দেখে আসি।এক ফাকে লগও দেখতে হবে। হয়ত কিছু পাওয়া যাবে। আর হ্যা, সবাই অয়ারলেস নিয়ে যেও। যেকোন দরকারে যোগাযোগ করা যাবে। মেইন পাওয়ার সিস্টেম চালু না করা পর্যন্ত অয়ারলেসই ভরসা।"
"ক্যাপ্টেন, আমার একটা টর্চ লাগবে।" - জীববিজ্ঞানী জিরোম বলে উঠল।
"ভাল কথা মনে করেছো। সবাই টর্চ নিয়ে নাও। রিবিনের তো লাগবে না। ওর চোখ আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। আরো কিছু যদি লাগে মনে করো, নিয়ে নিও।"
মাথা ঝাঁকিয়ে সবাই বেড়িয়ে গেল।
চার
সবাই চলে যেতে ক্যাপ্টেন সিহান সিডিসি কে ডাকলেন।
+ সিসি?
- বলুন ক্যাপ্টেন।
+ এই মুহূর্তে আমরা কোথায় আছি?
- আমার কোন ধারনা নেই ক্যাপ্টেন। আল্ট্রা জিরোটুর একমাত্র ক্যামরাটি কাজ করছে তার পাঠানো আশে পাশের ছবির সাথে আমার ডাটাবেসের ছবির কোন মিল নেই। আর হাইপার জাম্পের সময় রিটোনদের প্রচন্ড আক্রমণ চলতে থাকায় কিছু কিছু প্যারামিটার কন্ট্রোল করা সম্ভব হয় নি।
+ তারমানে বিশাল মহাশূন্যের যে কোন জায়গায় আমরা থাকতে পারি?
- হ্যা। তবে আমার হিসেব অনুযায়ী পৃথিবী এখান থেকে ৫০০ আলোকবর্ষ দূরে।
+ আমার সিস্টেম লগ দরকার।
- এক্ষুনি দেখাচ্ছি ক্যাপ্টেন।
বলতে না বলতে সিডিসি মনিটরে স্পেসশীপ আল্ট্রা জিরো টু'র রেকর্ড ভেসে উঠল। গত আধঘন্টা যা যা ঘটেছে সব কিছু ফুটে উঠল। পাওয়ার কনসাম্পশনের গ্রাফ দেখে ক্যাপ্টেন একটু অবাক হলেন।
******
******
"লিহা কলিং ক্যাপ্টেন, ওভার।"- ওয়্যারলেসে লিহার গলা ভেসে এল।
"লিহা, বলো।"- ক্যাপ্টেন সিহান জবাব দিলেন।
"পাওয়ার না থাকার কারনে জেনারেটর রুমের দরজা খোলা যাচ্ছে না। লেজার দিয়ে লক কেটে ফেলব নাকি?"
"হ্যা, কেটে ফেল। সাবধানে করো, ভিতরের কোন যন্ত্রপাতি যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।"
" ওকে ক্যাপ্টেন।"
লিহার সাথে কথা শেষ হতে ক্যাপ্টেন সিহান স্টোর রুমের দিকে এগোলেন। স্কাউট শিপগুলো চেক করা দরকার। মূল দরজার পাশেই ছোট একটা ম্যানহোল রয়েছে। পাওয়ার না থাকায় ম্যানহোল দিয়েই ভিতরে ঢুকতে হল। ম্যানহোল খোলার সময়ই ভিতরের বদ্ধ বাতাসের একটা ধাক্কা ক্যাপ্টেনের মুখে লাগল। ক্যাপ্টেন চিন্তিত হয়ে উঠলেন। বাতাসতো বদ্ধ হবার কথা না। আপাতত এ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে স্কাউটশিপ দুটো পরীক্ষায় মনযোগ দিলেন। প্রায় দশ মিনিটের মত লাগল। সব কিছু ঠিকঠাকই আছে।
হঠাৎই ক্যাপ্টেন সিহানের মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠল। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমান বেড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি স্টোর রুম থেকে বের হয়ে এলেন। এয়ার পিউরিফায়ার কোন ঝামেলা হয়েছে। দুঃচিন্তায় ক্যাপ্টেনের কপাল কুঁচকে গেল।
কন্ট্রোল রুমে ফিরে এসে ক্যাপ্টেন সিহান সবাইকেই দেখতে পেলেন। তার জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল।
"ক্যাপ্টেন, স্পেসশীপের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে গিয়েছে। আমি এয়ার পিউরিফায়ার চেক করে দেখেছি। রিটোনদের আক্রমনে ওটা পুরোপুরি অকেজো হয়ে গিয়েছে।"-প্রথমেই রিবিন রিপোর্ট করল।
"হ্যা, আমি ব্যাপারটা খেয়াল করেছি।"- ক্যাপ্টেন মাথা ঝাকালেন। "আর কি খবর?"
"আমি আর লিহা জেনারেটর গুলো চেক করে দেখেছি।" জীববিজ্ঞানী জিরোম শুরু করলেন। "একটা জেনারেটর অতিরিক্ত লোডে ট্রিপ করেছে। আরেকটা পুড়ে গিয়েছে। ভাগ্য ভাল আগুনটা ছড়িয়ে পড়ে নি। তবে ভিতরে ধোয়ার কারনে পুরোপুরি চেক করা যায় নি।"
"আমিও লগ চেক করার সময় দেখলাম স্পেসশীপে বিদ্যুৎ প্রবাহ চট করে কমে গিয়ে হুট করে বেড়ে গিয়েছিল। রিটোনদের শেষ আক্রমনে সম্ভবত এমন কিছু ছিল যা বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উপর আঘাত হেনেছে। এখানে থেকে ওগুলো ভালভাবে চেক করার সুযোগ নেই। তাছাড়া বাতাসের অক্সিজেনের পরিমাণ দ্রুত কমে যাচ্ছে। আমাদের যা করার দ্রুত করতে হবে। সেক্ষেত্রে কাছাকাছি এমন কোন গ্রহ খুজে পেতে হবে যেখানে আমরা নামতে পারি।" এক নিঃশ্বাসে ক্যাপ্টেন কথাগুলো বলে ফেললেন।
সবাই দ্রুত মাথা ঝাঁকাল।
+ সিসি?
- ক্যাপ্টেন বলুন।
+ আশেপাশে এমন কোন গ্রহ কি আছে যেখানে আমরা নামতে পারি?
- খুব কাছাকাছি নেই। তবে এখানে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার ডান দিকে একটা গ্রহ আছে যেখানকার আবহাওয়া পৃথিবীর কাছাকাছি। তবে ওতে নাইট্রোজেনের পরিমান কম। হিলিয়ামের পরিমান বেশি। অক্সিজেন আছে পৃথিবীর বায়মন্ডলের সমান।
+ ওখানে পৌছুতে কত সময় লাগতে পারে?
- ক্যাপ্টেন ওখানে পোছানো সম্ভব নয়। যেটুকু ইমার্জেন্সী পাওয়ার অবশিষ্ট আছে তাতে বড়জোড় আমরা ওটার ১০ কিলোমিটারের কাছাকাছি যেতে পারব।
"এখন কি হবে ক্যাপ্টেন?"- অজানা আশংকায় লিহার গলা কেঁপে গেল।
[সুদূর ভবিষ্যতে চলতে পারে]
No comments:
Post a Comment