কিছু কথা বলা দরকার। না বলে শান্তি পাচ্ছি না। কথাগুলো বলার আগে নিজের ঢোল নিজেই একটু বাজিয়ে নেই। নাহলে মানুষ ভাবতে পারে নিজের ঢোল নিজে পেটানোর মত লোক বুঝি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
ঈদের সময় চেষ্টা করি ঈদটা ফ্যামিলির সাথে করার জন্য। ছুটি পেলে যাই। আর না পেলে একা একাই করতে হয়। বাসায় গেলে ঈদের বাজার সদাই নিজেই করার চেষ্টা করি। মনের আনন্দে এটা ওটা কিনি। ঈদতো আনন্দের, আনন্দটা সবাইকে বোঝাতে হবে না?
আনন্দ প্রকাশ করলেই নিজের বিবেক-মনুষত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করি। ঝুরা সেমাই বলে একটা খাবার আছে। এই সেমাইটা রান্না করার জন্য লাল সেমাই লাগে। লাচ্ছা সেমাই দিয়ে হয় না। যতদূর মনে আছে হরিন মার্কা লম্বা লম্বা একটা সেমাই ছিল একসময়। এখন কুলসন সেমাই সে স্থান দখল করে ফেলেছে। ঝুরা সেমাই খেতে হলে এখন কুলসন (যতদূর জানি পাকিস্তানী) সেমাই কিনতে হবে।
খেলাম না ঝুরা সেমাই! মারা তো আর যাব না জ্বিবটাকে একটু সংযত রাখলে!
ছোটভাই বাজার করল কসমেটিকস এর। জিজ্ঞেস করাতে বলল, তিব্বত আর চাকা সাবান এনেছে। বললাম, গুড দেশি সাবান আনবি। বলে, আমি দেশি সাবানই আনি।
বহুদিন থেকেই ভাবছিলাম একটা টুথব্রাশ কিনতে হবে। দোকানে যেয়ে বলাতে বের করে দিল ৪-৫ টা। সুন্দর সুন্দর ব্রাশ! বললাম, বাংলাদেশী কোনটা? কোনটা কোনদেশী?
বাংলাদেশী খোজাতে ভিতর থেকে এনে দিল। দেখতে ততটা ভাল না। ব্রাশ দেখতে অত ভাল হবার কি আছে? দাঁত ব্রাশ করা গেলেই হল। বাংলাদেশী একটা পন্য কিনলাম।
প্রতি ঈদেই বাসায় সফট ড্রিংকস থাকতই। আমি না আনলেও ছোটভাই আনত। অন্যকিছু না হোক 7up তো থাকতই। এবার বাসায় কোন ড্রিংস আনা হয় নি। জানেন, এতে আমাদের ঈদ এতটুকু মলিন হয় নি! আমরা হাসিমুখেই ঈদ করেছি!
কেউ বলতেই পারেন। এইগুলা করে কি হবে? আমি একটা এতটুকুই বলতে পারি, বিবেকের দংশন থেকে কিছুটা মুক্তি। আর এমনিতে অন্যান্য নানান দংশনতো আছেই। আমরা যদি এই ছোট ছোট বিষয়গুলো একটু খেয়াল রাখি তবে ইন শা আল্লাহ, ইন শা আল্লাহ, একদিন বড় কিছু করার তৌফিক আল্লাহ তায়ালা আমাদের দেবেন। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
আজকাল টিভি-সিনেমায় দাড়ি-টুপিওয়ালাদের অসম্মান করার একটা প্রবনতা লক্ষ্য করি। ব্যথিত হই। রানওয়ে দেখেছি, গেরিলা দেখছি। দেখে মনে হয়েছে, দেশের সমস্ত অরাজকতা তৈরি করছে দাড়িটুপিওয়ালারা। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন মুসলমান যুদ্ধ করেনি। করেছে সব অমুসলিমরা। তারাই পাকিস্তানীদের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে। তাই অসম্মানই তাদের প্রাপ্য।
বাংলাদেশের সাধারণ জনগন তাদের মত করে ভাবে না। তারা দাড়িটুপিওয়ালাদের সম্মান দিতে জানে। দাড়িটুপিওয়ালারাও মানুষের সম্মান দিতে জানে। আর যারা জানে না বা মানে না তাদের কোন ক্লাস নেই। যেকোন ক্লাসেরই তারা হতে পারে।
পলাশ থেকে ঢাকা আসব। কুখ্যাত মুড়ির টিন মেঘালয়ে উঠলাম। হাতে দুইটা ভারী ব্যাগ। কোন মতে সিট পেয়ে বসে গেলাম। হাটু ঢুকে না। বাকা হয়েই বসতে হল। ঘোড়াশাল থেকে একটা মেয়ে উঠল। আপাদমস্তক কালো বোখরায় ঢাকা। সাথে একটা ছেলে। মনে হল ভাই-ই হবে। একটা সিটও খালি নেই। মেয়েটির দাড়ানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল দাঁড়িয়ে সে ভ্রমণ করতে পারবে না। সিট ছেড়ে দিলাম। একটা ব্যাগ পায়ের পাশে রেখে একহাতে আরেক ব্যাগ আর এক হতে বাসের হাত ধরে কোন মতে দাড়ালাম। মেয়েটি আমার হাতের ব্যাগটা নিচে তার দু'পায়ের পাশে রাখতে অনুরোধ করলেও সমস্যা নেই বলে এড়িয়ে গেলাম। কিছুক্ষন পরেই সামনের সিটে জায়গা পেয়ে গেলাম।
চকবাজার থেকে প্রবর্তক আসব। উঠলাম টেম্পুতে। টেম্পু প্রায় ভরে উঠেছে। ৩:৩:৩ হয়েছে যাত্রী সংখ্যা। আরেকজন হলেই ছেড়ে দেবে। এমন সময় একটা মেয়ে আসল। ইতস্তত করছে। আমি উঠে পাশের সিট থেকে ভিতরের সিটে বসলাম। এতে সেই সিটের সহযাত্রী আমার উপর রেগে গেল। বাচ্চাপোলার গরম গরম কথা শুনলাম। "আপনি যেমন সম্মান করলেন? এই মেয়ে কি তেমন সম্মান করত?" -এই টাইপ কথা বার্তা।
কথা যে একবারে অমূলক তাও না। ফাতরামি করার মত মেয়েও দেখেছি জীবনে। আমি আর আমার এক বড়ভাই সিলেটে গেলাম বেড়াতে। তো টাউনের ভিতরেই একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবো। লোকাল সিএনজি খুজছি। একটু পরে একটা পেলাম। ভিতরে একজন যাত্রী। ইয়ং এক মেয়ে। মনে হয় সাস্টে পড়ে। আমি ইতস্তত করতে করতে উঠলাম। মাঝে আমি আর দু'পাশে মেয়ে আর বড় ভাই। সতর্ক রইলাম যেন ঘষা না লাগে। একটু ফাঁক রেখেই বসলাম। মেয়ে মোবাইল টিপে। একটু পর খেয়াল করলাম। ফাঁকটুকু ভরাট হয়ে গিয়েছে। আমি বড়ভাইকে চাপ দিয়ে আরেকটু ফাঁক করলাম আর শক্ত কাঠ হয়ে বসে রইলাম। একটু পর আবারো একই অবস্থা। মেয়ে আরো চেপে বসেছে! মেয়ে আমার কোল আর আমি বড়ভাইয়ের কোল উঠার দশা! গন্তব্য এসে পড়াতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
সম্ভবত ঢাকা থেকে চিটাগাং আসব। টিকেট কেটে বাসে উঠেছি। উঠেই চোখ পড়ল এক সুন্দরীর সাথে। একাই বসেছে। পাশের সিট খালি। আমি পাশ কাটিয়ে পিছনদিকে আমার সিটে যেয়ে বসলাম। একটু পর এক মুরুব্বী উঠলেন। দাড়ি-টুপি-জোব্বাওয়ালা। সামনে সিট খালি দেখে সুন্দরীকে বললেন, এই সিট খালি আছে কি?
সুন্দরী লাগিয়ে দিল ঝগড়া। মেয়ে দেখলে আপনাদের হুশ থাকে না?-টাইপ কথাবার্তাও বলল। লোকটা পরে পিছনে এসে দুঃখ করল। দেখলেন কি ব্যবহারটা করল? আমি তার বাবার বয়সী!
আমরাও দুঃখিত চোখে তাকে দেখলাম।
সাধারণ জনগনের কিন্তু এমন নয়। এই রোযার মধ্যে আন্দরকিল্লা গিয়েছিলাম। কিনলাম তফসীরে ইবনে কাসীর, তিরমিজি শরীফ, মেশকাত শরীফ, রিয়াদুস সালেহীন। দুটো বান্ডিল দু'হাতে নিয়ে বেশিক্ষন হাটা যায় না। নতুন ব্রীজ আসলাম। এখানে দাড়ালাম রাস্তার পাশে। অফিসের গাড়ির জন্য অপেক্ষা। রাস্তার পাশেই টং দোকান। রোযার মধ্যেও সরগরম।
এরই মধ্যে আকাশ কালো হয়ে উঠেছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমি ভিজলে সমস্যা নেই। বইগুলো ভিজলেইতো মুশকিল। এমন সময় টং দোকানটার পাশের এক লোক বলল, "হুজুর এইগুলো কি কোরআন শরীফ না?" আমি মাথা ঝাকাতেই সে বলল, "এখানে রাখলেতো ভিজে যাবে।" বলে সে নিজেই বান্ডিলদুটো নিয়ে টং এর ভিতরে নিয়ে গেল। কাপড় দিয়ে ঘেরা টং এর ভিতরে থাকলে অন্যের খাওয়া দাওয়া দেখতে হবে, আর অফিসের গাড়িও চোখে পড়বে না। তাই বাইরে এসে দাড়ালাম।
কতবার এমন হয়েছে যে, বাসে দাঁড়িয়ে আছি। সিট খালি হতে নিজে না বসে আমাকে বসতে দিয়েছে। কোন বাসায় গেলে মেয়েরা\মহিলারা আমাকে দেখে মাথায় কাপড় দিয়েছে। আমাকেও সম্মান করেছে, নিজেরাও সম্মানিত হয়েছে!
এমন অসংখ্য ছোট ছোট ঘটনা আমাদের দৈনন্দিক জীবনে ঘটে যাচ্ছে। তাই না?
আমি কোন মহামানব নই। অতি সাধারন একটা ছেলে। অতি সাধারন যার চিন্তা-ভাবনা। আমি বিশ্বাস করি, আমার মত হাজার হাজার সাধারন ছেলে/মেয়ে বাংলাদেশে আছে। যাদের ছোট ছোট কাজের দ্বারা সমগ্র দেশবাসী/পৃথিবীবাসী উপকৃত হচ্ছে। আমাদের কোন সংঘটন নেই। আমরা সবাই যেদিন এইসব ছোট খাট বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন হব তখন জীবনটা আসলেই অন্যরকম হয়ে যাবে।
আমি সেই দিনের অপেক্ষায়!!
No comments:
Post a Comment