ইদানিং ও কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছে। কিছু বলে না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই দূরত্ব টের পাচ্ছি। ও কখনোই মুখ ফুটে কিছু বলেনি। বরং আমি যতটুকু দিয়েছি পরম আগ্রহে তা গ্রহণ করেছে। কোন কারণে দিতে না পারলে কোন অভিযোগ করেনি।
ব্যাপারগুলো আমি যে বুঝি না তা নয়। বুঝি ঠিকই। অফিস, সাংসারিক নানান ঝামেলা, লেখালেখি নিয়ে মগ্ন থাকার কারনে ওকে সময় দেয়া হচ্ছে না। কম্প্যূটারের মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে আমি ওর দিকে আড়চোখে তাকাই। দেখি, আমার দিকে তাকায় কিনা। তাকায় না। একমনে কাজ করে যাচ্ছে। ওর এই একমনে কাজ করার মাঝে আমি অদ্ভূত এক অভিমান টের পাই। সেই অভিমানের উৎস যে গভীর ভালবাসা সেটা আমি বুঝতে পারি।
নাহ্, ওকে এভাবে বঞ্চিত করা ঠিক হচ্ছে না। ওকে নিয়ে কোথাও দু'একদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া দরকার। তাহলে হয়ত ওর প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে।
সারাটা দিন বাসায় একা একা থাকে। কিভাবে সময় কাটে কে জানে! আর আমি ফিরেই কম্প্যূটার নিয়ে বসে পড়ি। বিরাট সেলেব্রেটি আমি! ফেসবুকে পোস্ট না দিলে রাতে ঘুম হয় না। কতজনের সাথে কত কথা বলি! কিন্তু ঘরে যে একজন আছে যে কিনা আমার সাথেই কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকে, আমার কাছ থেকে একটু মনোযোগ আশা করে- তার জন্য আমার সময় হচ্ছে না।
আজ থেকে ওকে সময় দিতে হবে। অফিসে বসে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এই ডিসিশনে আসি।
রাত সাড়ে দশটায় বাসায় ফিরলাম। ও দরজা খুলতেই সালাম দিয়ে একটা হাসি দিলাম। ও অন্যমনস্কভাবে আমার সালামের উত্তর দিল। হাসিটা মনে হয় বৃথা গেল। আমি গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরমধ্যে ও টেবিলে খাবার দিয়েছে।
অন্যদিন হুটহাট খেয়ে উঠলেও আজ একটু সময় নিলাম। খাবারটা বড্ড নীরস লাগছে। চুপচাপ খাচ্ছি। কোন কথা নেই। ও মাথা নিচু করে খেয়ে চলেছে। আমি যে ওকে বার বার লক্ষ করছি মনেহল তা বুঝতে পারছে। কিভাবে কি বলে পরিবেশ হালকা করব ভেবে আমার মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলোর মধ্যে দ্রুতগতির ইলেক্ট্রণ প্রবাহ শুরু হয়েছে।
খাওয়া শেষ হতে সে খুব দ্রুত টেবিল গুছিয়ে ফেলল। তারপর ব্রাশ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমি এদিক সেদিক কিছুক্ষন পায়চারী করে বিছানায় ওর পাশে গিয়ে বসলাম।
>নীলা......
>>উম্ম্ম...
>ঘুমিয়েছো?
>>নাহ্...ঘুমাইনি।
>চলো বাইরে যাই। হেটে আসি...
>>না...
>কেন?
>>এমনি... ভাল্লাগছে না...
আমি বুঝলাম এগুলো ওর অভিমানের কথা। সত্য না।
আমি ওর বামহাতের তালু আমার দু'হাতের মুঠো দিয়ে ধরলাম। ও আমার দিকে তাকাল।
"জানো নীলা, আমি ছোটবেলা থেকেই মানুষের সাথে মিশতে পারতাম না। লজ্জা লাগত। বাসায় অনেক দুষ্টুমি করলেও কোথাও গেলে একদম চুপচাপ হয়ে যেতাম। অসম্ভব জেদি ছিলাম বলে আব্বা-আম্মার অনেক বকা খেয়েছি। কোন কিছু হলেই কেঁদে কেটে চোখের জ্বলে ভাসিয়ে দিতাম।
বাংলা সিনেমাতে অনেক সময় দেখায় না যে, মা সন্তানের জন্য নিজে না খেয়ে সন্তানের পাতে ভাত তুলে দিচ্ছে? আমাদের জীবনটা ঠিক তেমনি ছিল একসময়। আম্মা না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন। নিজের ক্ষুধার চোটে মায়ের ক্ষুধার কথা মনে থাকেনি। তারপর যখন বুঝতে পেরেছি তখন আর কিছু করার ছিল না।
আম্মা সকাল বেলা ভাত রান্না করতেন আর হয়ত একটা ডিম ভেজে দিতেন। আমরা চারভাইবোন সেই ডিম চারভাগ করে খেয়ে যার যার কাজে চলে যেতাম। দুপুর একটা তরকারী রান্না হত। অল্প অল্প করে খেতাম যেন রাতেও সেই তরকারী দিয়েই খাওয়া যায়। বড়মাছ আমার খুব প্রিয়। এখনতো একচাক করে খাই। মাঝে মাঝে দু'চাকও খেয়ে ফেলি ভাল লাগলে। তখন একচাকের চারভাগ দিয়ে খেতাম। প্রায়ই দেখা যেত আম্মা বা বোন মাছ খাচ্ছেন না। তাদের ইচ্ছে ছিল তাদের সেই অংশটুকু আমি খাই। বুঝতাম না। খেয়ে ফেলতাম।
কতইবা বয়স তখন। সবাই কি সুন্দর সুন্দর কাপড় চোপড় পড়ত। আমারো ইচ্ছে করত তাদের মত স্মার্ট হয়ে চলি। ভাল কাপড় চোপড় পড়ি। দামী দেখে জুতা পায়ে দেই। ভাল দেখে একটা হাতঘড়ি কিনি। পারিনি।
ক্লাশ এইট থেকে টিউশনি শুরু করি। প্রথম মাসে বেতন পেয়ে কি খুশি আমি! কতই বা পেয়েছিলাম? মনে হয় দু'শ টাকা। সেই টাকা দিয়ে প্রথম নিজের উপার্জনে বাজার করি। ছোট ভাই-বোনদের জন্য বিস্কিট, চানাচুর এনেছি। তাদের মুখে হাসি দেখে হেসেছি।
কলেজে উঠে কত বলাবলির পর আম্মা একজোড়া সু কিনে দিয়েছিলেন! সবার চকচকে সু এর পাশে আমার কমদামী সুজোড়া মলিন লাগলেও অভিযোগ করিনি। আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলে যেতে ইতস্তত লাগত। ভাল কোন ড্রেস নেই এইসব অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য। তার উপর রয়েছে গিফট কেনার ঝামেলা। কি গিফট নিব? একেবারে খালি হাতে যাওয়া যায়? গিফট কিনব, টাকা কোথায়? কলেজের বই কেনার পয়সা নেই, গিফট কিনব কোথ্যেকে?
সাইন্সের স্টুডেন্ট ছিলাম। ৩-৪ টা প্রাইভেট পড়া লাগে। সবাই পড়ে। কেউবা আরো বেশি পড়ে। আমি পড়ি দু'টো। সেই দু'টোর টাকা জোগাড় করি নিজে কয়েকটা টিউশনি করে। তারপরও মাঝে মাঝে বাসা থেকে টাকা নিতে হয়। একটা প্রাইভেট বন্ধ করে অন্য আরেকটা বিষয় পড়তাম। ফর্ম ফিলাপের সময় ১৪০০ টাকা লাগবে। এত টাকা কোথায় পাই? বাধ্য হয়ে মানুষের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি।
কলেজে উঠে সবাই একটু রঙিন রঙিন থাকে। সবাই পৃথিবী রঙিন দেখে। এর-ওর কাছে কত গল্প শুনেছি। এ ওর সাথে প্রেম করে, ডেটিং করেছে, চিঠি লিখেছে, চিঠি পেয়েছে। আমরা কি ইচ্ছে করত না? করত।
আমারো ইচ্ছে করত আমার একটা ভালবাসার মানুষ হোক। কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করুক। কাউকে দেখার জন্য চুপি চুপি তার বাসার সামনে ঘুরাঘুরি করি। তার কলেজের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি। তাকে একটা চিঠি লিখি। দুরু দুরু বুকে তার সাথে একটু কথা বলি। কোন রেস্টুরেন্টে বসে কিছু একটা খাই। ভালবাসা দিবসে তাকে টকটকে একটা লাল গোলাপ উপহার দেই। জন্মদিনে তার কাছ থেকে একগাদা শুভেচ্ছা নেই।
মনে মনে ভাবতাম আমার যখন মনের মানুষ হবে তখন তার সাথে ভালবাসার কথা বলব। ইচ্ছে করেই তাকে রাগিয়ে দেব। তারপর তার রাগ ভাঙাতে বিভিন্ন ছেলেমানুষী করব। সবশেষে সে যখন ভেঙে আমার দিকে তাকাবে তবে তাকে একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিব। তাকে এমনভাবে ভালবাসব যেন সে অনুভূব করবে যে, এমনভাবে আর কেউ তাকে ভালবাসতে পারবে না।
বহুদিন পরে তুমি আমার জীবনে এসেছো। কত দীর্ঘ, নির্ঘুম রজনীর একাকী নিসঙ্গতার কষ্ট পেরিয়ে তোমাকে পেয়েছি!
প্রথমদিনই তোমাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। তোমার কাছাকাছি এসে দিন দিন আরো মুগ্ধ হয়েছি। আমার পৃথিবী কেবল তুমিময়। তুমি ছাড়া অন্যকেউ, অন্যকিছু আমার মনের ঘরে নেই।
তবুওতো মানুষের ভুল হয়। আমারও ভুল হয়েছে। আমার বউটার খবর আমি নেই নি। ভুল করেছি, দোষ করেছি। আর করব না। আমার বউটা যদি আমার উপর অভিমান করে দূরে সরে থাকে তবে মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেও না। আমার পৃথিবীটা শূন্য করে দিও না।"
নীলা কাঁদছে। ওর চোখের কোন ঘেষে মুক্তোদানাগুলো গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমি দৌড়ে যেয়ে একটা গ্লাস এনে ওর চোখের কোণ ধরলাম। ও ধরমড়িয়ে উঠে বসল।
>কি হচ্ছে?
>>মুক্তো ধরছি...
>উউউ ...ঢং...থাক আর ঢং করা লাগবে না।
>>চলো হেটে আসি।
>এত রাতে বাইরে গেলে মানুষ কি বলবে?
>>আমি আমার বউকে নিয়ে বাইরে যাব। তাতে কার কি?
> ইস্স্স...খুব বউ বউ করা হচ্ছে। এই "বউ বউ" করেই তুমি আমার মাথাটা খেয়েছো!
আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটা ভুবনজয়ের হাসি দিলাম।
রাত্রি গভীর হচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে রাস্তার সোডিয়াম লাইটগুলো উজ্জ্বল হচ্ছে। কলোনীর সিকিউরিটি, আনসাররা সেই আলোতে অবাকে হয়ে দেখছে এই গভীর রাতে একজোড়া ছেলে-মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছে। তারা কোন কথা বলছে না, শুধু মেয়েটি গভীর ভালবাসায় ছেলেটির হাত জড়িয়ে ধরে আছে।
No comments:
Post a Comment