আমাদের দেশে নামাযের পর সাধারণত মুনাজাত করা হয়। জামাআতের নামায হোক বা একাকী নামায হোক, আমরা মোনাজাত করেই থাকি। আমাদের যা কিছু চাওয়ার আল্লাহর দরবারে চাই। তবে ফরয সালাতের পর আমরা দু'হাত তুলে যে মোনাজাত করে থাকি তা জরুরী কিছু নয়। এটাকে জরুরী মনে করা যাবে না। অথচ অনেক মুসল্লী এই মোনাজতকে জরুরী মনে করে থাকেন। আগ্রহভরে অপেক্ষা করে থাকেন। কোন ইমাম সাহেব মোনাজাত না করলে অবাক হন, বিরক্ত হন, রাগান্বিত হন।
এমন কোন সহীহ হাদীসের বর্ণনা আমার জানা নেই যেখানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জামাআতে ফরয সালাত আদায়ের পর সাহাবীদের (রাঃ) নিয়ে সম্মিলিতভাবে মোনাজাত করেছেন। এটা আমাদের দেশে অনেকটা আনুষ্ঠানিক হয়ে গিয়েছে। করার জন্য করা। প্রাণহীন! আর মোনাজাতের যেসব আদব আছে তাও এর মাধ্যমে পূরণ হয় না।
মোনাজাতের আদব আবার কি?
১. দু'হাত বুক বরাবর তোলা
২. দু'হাতের মাঝে একটু ফাঁকা রাখা
৩. হাতের তালু আসমানের দিকে রাখা
৪. আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর দরূদ দ্বারা মোনাজাত শুরু করা।
৫. মোনাজাতে কাঁদা। কান্না না আসলে অন্তত কান্নার ভঙ্গি করা।
৬. সময় নিয়ে মোনাজাত করা।
৭. চোখ খোলা রাখা
আরো কিছু আছে। মনে নেই। উপরের কথাগুলোর কোন রেফারেন্স দিতে পারলাম না। দুঃখিত।
এখন প্রচলিত মোনাজাতে এই আদবগুলোর কোনটা রক্ষা হয় আমরা নিজেরাই একটু ভেবে নেই।
এখন আসল কথায় আসি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফরয নামাযের পর কি আমল করতেন, কি তসবীহ, তাহলীল, জিকির করতেন সে বিষয়ে ছোট এক বই আমার হস্তগত হয়েছে। বইটি যথেষ্ঠ নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে বিধায় সবার সাথে শেয়ার করছি। বইটির নাম "সালাতের পর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব দোয়া পড়তেন" বইটি লিখেছেন "মুফতী কাজী মুহাম্মাদ ইবরাহীম, প্রধান মুহাদ্দিস, জামেয়া কাসেমীয়া, নরসিংদী। খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মতিঝিল সরকারি কলোনি। (আল-হেলাল জোন) ঢাকা-১০০০
প্রতিটি দোয়া পয়েন্ট আকারে দেয়া হয়েছে এবং আরবী দোয়াগুলো পয়েন্ট অনুযায়ী ছবি হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে।
(ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক ফরজ সালাতে সালাম ফেরানোর পর একবার "আল্লাহু আকবার", তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ ও একবার "আল্লাহুম্মা আনতাস সালামু অয়া মিনকাস্ সালাম তাবারাকতা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম" পড়তেন। অতঃপর মুসল্লিগনের দিকে ফিরে বসতেন এবং অন্যান্য দোয়া পড়তেন।
সালাম ফেরানোর পর সরবে একবার 'আল্লাহু আকবর' বলবে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি তাকবীর দ্বারা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাতের সমাপ্তি সম্পর্কে অবহিত হতাম।
অর্থাৎ সালাম ফেরানোর পর ইমাম (রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও মুক্তাদিগণ (সাহাবীগণ) সরবে একবার আল্লাহু আকবার বলতেন।
1.[pic1] আস্তাগফিরুল্লাহ (তিনবার বলবে)। (অতঃপর)'আল্লাহুম্মা আনতাস্ সালামু ওয়া মিনকাস্ সালাম তাবারাকতা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম' বলবে।
"সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতের সালাম ফেরাতেন তখন তিনি তিনবার ইস্তেগফার পড়তেন অর্থাৎ 'আস্তাগ্ফিরুল্লাহ' বলতেন। তারপর বলতেনঃ হে আল্লাহ! তুমি শান্তিময়, তোমার থেকেই শান্তি অবতীর্ণ হয়। তুমি বরকতময়, হে পরাক্রমশালী ও মর্যাদা প্রদানকারী।"
বিঃদ্রঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত ইস্তেগ্ফার ও দোয়া তাকবীরের পর পড়তেন।
2. [pic2] অর্থঃ এক আল্লাহ ব্যতীত দাসত্বের যোগ্য আর কেউ নেই। তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই। সার্বভৌম রাজত্ব এবং সকল প্রশংসা তাঁরই। আর তিনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। সকল বিষয়ের শক্তি দান ও অবস্থান্তর মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। আল্লাহ ব্যাতীত কোন মাবূদ নেই। আর আমরা তো তিনি ভিন্ন আর কারো দাসত্ব করি না। অবদান, অনুগ্রহ ও সুন্দর গুণগান তো তাঁরই প্রাপ্য। আনুগত্যকে তার জন্য নিরংকুশ করে (আমরা বলছি) "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" যদিও অবিশ্বাসীরা তা অপছন্দ করে।
3. [pic3] মুগীরা ইবনু শু'বা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) প্রত্যেক সালাতের পর বলতেন- আল্লাহ ব্যতীত কোন মা'বূদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই, সার্বভৌম রাজত্ব ও প্রশংসা তাঁরই, তিনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান। হে আল্লাহ! আপনি যা দান করবেন তা প্রতিহত করার কেউ নেই। আর আপনি যা দেবেন না তা দেয়ার কেউ নেই। আপনার ইবাদত ও আনুগত্য সম্পদশালীকে (তার সম্পদ) কোন উপকার দেবে না।
5.[pic5] পরপর আগত কিছু কালেমা এমন রয়েছে প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর যার উচ্চারণকারী অথবা আমলাকারী ব্যর্থ হবে না। ৩৩ বার 'সুব্হানাল্লাহ্', ৩৩ বার 'আলহামদুলিল্লাহ্' ও ৩৪ বার 'আল্লাহু আকবার'।
6.[pic6] আলী ইবনু আবু তালিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত-রাসূল (সাঃ) যখন সালাতের সালাম ফেরাতেন তখন বলতেন, হে আল্লাহ আমি আগে ও পরে যত পাপ করেছি, প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে যা করেছি এবং যাতে সীমালঙ্ঘন করেছি, আর যা আপনি আমার চেয়ে অধিক জানেন সে সব ক্ষমা করে দিন। আপনিই এগিয়ে দেন এবং আপনিই পিছিয়ে দেন। আপনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।
7.[pic7] যায়েদ ইবনু আরকাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)কে তাঁর সালাতেশেষে বলতে শুনেছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রভু এবং সকল কিছু প্রভু। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি এক, তোমার কোন অংশীদার নেই। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রভু এবং সকল কিছুর প্রভু। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ (সাঃ) তোমার বান্দা এবং তোমার রাসূল।
হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রভু এবং সকল কিছুর প্রভু। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, বান্দারা সকলেই ভাই ভাই। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রভু এবং সকল কিছু প্রভু। তুমি আমাকে তোমার নিজের জন্য বিশুদ্ধচিত্ত/খাছ করে নাও এবং আমার পরিবারকেও প্রতিটি মুহূর্তে দুনিয়া-আখিরাতে(বিশুদ্ধচিত্ত/খাস করে নাও)
হে পরাক্রমশালী ও মর্যাদা দানকারী! তুমি শোন এবং কবুল করো। আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়। আল্লাহ আকাশ্মদণ্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি। আল্লাহই হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ঠ এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক। আল্লাহ সবচেয়ে বড়, তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ।
8.[pic8] সা'দ ইবনু আবি ওয়াক্কাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, শিক্ষক শিশুদেরকে যেমনিভাবে লেখা শিখিয়ে থাকে, তেমনিভাবে তিনি নিজ সন্তানদেরও কালেমাগুল শেখাতেন এবং তিনি বলতেন, রাসূল (সাঃ) এ বাক্যগুলোর দ্বারা সালাতের পর আল্লাহর আশ্রয় চাইতেন।
অর্থঃ "হে আল্লাহ! আমি কাপুরুষতা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই। এবং (বার্ধক্যের) নিকৃষ্টতম জীবনে ফিরিয়ে নেয়া থেকেও আপনার কাছে আশ্রয় চাই এবং কবরের আযাব থেকে আপনার আশ্রয় চাই। আরো আশ্রয় চাই আপনার কাছে দুনিয়ার ফিতনা থেকে।"
9.[pic9] আবু আইউব আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত-তিনি বলেন,
অর্থঃ আমি যখনই তোমাদের নবী (সাঃ)এর পিছনে সালাত পড়েছি তখনই সালাত শেষ করার পর তাঁকে বলতে শুনেছি, হে আল্লাহ! আমার সকল ত্রুটি ও পাপ ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ! আমার মর্যাদা বাড়িয়ে দাও, আমাকে জীবিত রাখ, আমাকে জীবিকা দাও। সৎ কাজে ও সৎ চরিত্রের প্রতি পথ প্রদর্শন করাও এবং অসৎকাজ ও অসৎ চরিত্র থেকে বিরত রাখার মত তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।
[খ] আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে। "যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর 'আয়াতুল কুরসী' পাঠ করবে তাকে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই জান্নাতে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে না"
[গ] সূরা ফালাক ও সুরা নাস পাঠ করবে। ওকবা ইবনু আমের (রাঃ) বলেন, "রাসূল (সাঃ) আমাকে প্রত্যেক সালাতের পর মুয়াব্বিজাত (সূরা ফালাক ও সূরা নাস) পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।"
10.[pic10] মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) বর্ণনা করেন-"রাসূল (সাঃ) তাঁর হাত ধরে বলেছেন, হে মুয়াজ! আল্লাহর কসম আমি তোমাকেই ভালবাসি। অতঃপর তিনি বললেন- হে মুয়াজ! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, প্রত্যেক সালাতের পর একথা বলা ত্যাগ করো না, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তোমার স্মরণ, তোমার কৃতজ্ঞতা ও তোমার সুন্দর ইবাদতের উপর সাহায্য কর।"
11.[pic11] আবু বাক্রাহ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)কে সালাতের পর এই দোয়া পড়তে শুনেছি।
অর্থঃ "হে আল্লাহ! আমি কুফর, দারিদ্র্য ও কবরের আযাব হতে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।"
12.[pic12] আয়েশা (রাঃ) এর বর্ণনা অনুসারে রাসূল (সাঃ) প্রত্যেক সালাতের পর এ দোয়া পড়তেন।
অর্থঃ "হে আল্লাহ! তুমি জিবরাইল, মিকাইল ও ইসরাফিলের প্রভু। আমাকে জাহান্নামের উত্তাপ ও কবরের আযাব হতে আশ্রয় দান কর।"
13.[pic13] বারা ইবনু আযেব (রাঃ)-এর বর্ণনা অনুসারে ফরজ সালাতের পর রাসূল (সাঃ) এ দোয়া পড়তেন।
অর্থঃ "হে আমার প্রভু! যেদিন তোমার বান্দাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করবে সেদিন তোমার শাস্তি থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দিও।"
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
১. 4 নং পয়েন্ট নেই। এটা কোন ত্রুটি নয়।
২. আরবী সাথে বাংলা একারনেই দেয়া হয়েছে অনেক হরফ বোঝা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে যেন বাংলা দেখে বোঝা যায় হরফটি কি ছিল।
৩. এই ডকুমেন্টের শর্টকাটও আমার কাছে পাওয়া যাবে। শুধু দোয়াগুলো নিয়ে। এক কাগজে প্রিন্ট করে পকেটে রাখলে নামাযের পর পড়া যাবে। যারা আগ্রহী তারা বললেই আমি দিব।
এটা নিয়ে আরো একটা পোস্ট দেবার ইচ্ছা আছে। দেখা যাক। আল্লাহ তওফীক দিলে দিব।
No comments:
Post a Comment