[এই পোস্টটি মাননীয় শেখ আব্দুল আজিজ বিন বায এর 'ইসলামী হিজাব বা পর্দা' বইটির একটি অংশ। প্রতি মুসলিম নারীর অবশ্য পাঠ্য। আশাকরি, বর্তমানে যারা পর্দা (?) করেন তাদের অনেকের কিছু ভ্রান্তধারনার অবসান হবে]
বোন খাওলা একজন জাপানী নাগরিক। তিনি বর্তমানে রিয়াদস্থ জাপানী দূতাবাসে কর্মরত তাঁর স্বামীর সাথে রিয়াদে অবস্থা করছেন। গত ২৫/১০/১৯৯৩ তারিখে তিনি সৌদি আরবের আল-কাসীম প্রদেশের কেন্দ্র "বুরাইদা" শহরের ইসলামি কেন্দ্রের মহিলা বিভাগে আসেন এবং ইসলাম ও পর্দা সম্পর্কে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ইংরেজী ভাষায় একটি লিখিত প্রবন্ধ পড়ে শোনান। পরে উপস্থিত বোনেদের সাথে আলোচনা ও মত বিনিময় করেন। তাঁর মূল প্রবন্ধটির বঙ্গানুবাদ এখানে পেশ করা হল।
আমার ইসলামঃ
ফ্রান্সে অবস্থান কালে আমি ইসলাম গ্রহণ করি। ইসলাম গ্রহনের পূর্বে অধিকাংশ জাপানীর ন্যায় আমিও কোন ধর্মের অনুসারী ছিলাম না। ফ্রান্সে আমি ফরাসী সাহিত্যের উপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর লেখাপড়ার জন্য এসেছিলাম। আমার প্রিয় লেখক ও চিন্তাবিদ ছিলেন সাঁর্তে, নিৎশে ও কামাস। এদের সবার চিন্তাধারাই নাস্তিকতাভিত্তিক।
ধর্মহীন ও নাস্তিকতা প্রভাবিত হওয়া সত্ত্বেও ধর্মের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ ছিল। আমার অভ্যন্তরীণ কোন প্রয়োজন নয়, শুধুমাত্র জানার আগ্রহই আমাকে ধর্ম সম্পর্কে উৎসাহী করে তোলে। মৃত্যুর পরে আমার কি হবে তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা ছিল না, বরং কিভাবে জীবন কাটাব এটাই ছিল আমার আগ্রহের বিষয়।
দীর্ঘদিন ধরে আমার হচ্ছিল আমি আমার সময় নষ্ট করে চলেছি, যা করার তা কিছুই করছি না। ঈশ্বরের বা স্রস্টার অস্তিত্ব থাকা বা না থাকা আমার কাছে সমান ছিল। আমি শুধু সত্যকে জানতে চাইছিলাম। যদি স্রস্টার অস্তিত্ব থাকে তাহলে তাঁর সাথে জীবন যাপন করব, আর যদি স্রস্টার অস্তিত্ব খুজে না পাই তাহলে নাস্তিকতার জীবন বেছে নেব, এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।
ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে আমি পড়াশুনা করতে থাকি। ইসলাম ধর্মকে আমি ধর্তব্যের মধ্যে আনিনি। আমি কখনো চিন্তা করিনি যে এটা পড়াশোনার যোগ্য কোন ধর্ম। আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, যে ইসলাম ধর্ম হল মূর্খ ও সাধারণ মানুষদের একধরনের মুর্তিপূজার ধর্ম। কত অজ্ঞানই না আমি ছিলাম!
আমি কিছু খৃষ্টানের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করি। তাদের সাথে আমি বাইবের অধ্যয়ন করতাম। বেশ কিছুদিন গত হবার পর আমি স্রস্টার অস্তিত্বর বাস্তবতা বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমি এক নতুন সমস্যার মধ্যে পড়লাম, আমি কিছুতেই আমার অন্তরে স্রস্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছিলাম না, যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে স্রস্টার অস্তিত্ব রয়েছে। আমি গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বৃথাই চেষ্টা, আমি শুধু স্রস্টার অনুপস্থিতিই অনুভব করতে লাগলাম।
তখন আমি বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যয়ন করতে শুরু করলাম। আশা করছিলাম এই ধর্মের অনুশাসন পালনের এবং যোগাভ্যাসের মাধ্যমে আমি ঈশ্বরকে অনুভব করতে পারব। খৃষ্টানধর্মের ন্যায় বৌদ্ধধর্মেও আমি অনেক কিচু পেলাম যা সত্য ও সঠিক বলে মনে হল। কিন্তু অনেক বিষয় আমি বুঝতে বা গ্রহণ করতে পারলাম না। আমার ধারনা ছিল, ঈশ্বর বা স্রস্টা যদি থাকেন তাহলে তিনি সকল মানুষের জন্য এবং সত্য ধর্ম অবশ্যই সবার জন্য সহজ ও বোধগম্য হবে। আমি বুঝতে পারলাম না, ঈশ্বরকে পেতে হলে কেন মানুষকে স্বাভাবিক জীবন পরিত্যাগ করতে হবে।
আমি এক অসহায় অবস্থায় নিপতিত হলাম। ঈশ্বরের সন্ধানে আমার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা কোন সমাধানে আসতে পারলাম না। এমতাবস্থায় আমি একজন আলজেরীয় মুসলিমের সাথে পরিচিত হলাম। তিনি ফ্রান্সেই জন্মেছেন, সেখানেই বড় হয়েছেন। তিনি নামাজ পড়তেও জানতেন না। তার জীবনযাত্রা ছিল একজন সত্যিকার মুসলিমের জীবনযাত্রা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস ছিল খুবই দৃঢ়। তার জ্ঞানহীন বিশ্বাস আমাকে বিরক্ত ও উত্তেজিত করে তোলে। আমি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
শুরুতেই আমি পবিত্র কুরআনের এক কপি ফরাসী অনুবাদ কিনে আনি। কিন্তু আমি ২ পৃষ্ঠাও পড়তে পারলাম না, কারণ আমার কাছে তা খুবই অদ্ভূত মনে হচ্ছিল।
আমি একা একা ইসলামকে বোঝার চেষ্টা ছেড়ে ছিলাম এবং প্যারিস মসজিদে গেলাম, আশা করছিলাম সেখানে কাউকে পাব যিনি আমাকে সাহায্য করবেন।
সেদিন ছিল রবিবার এবং মসজিদে মহিলাদের একটি আলোচনা চলছিল। উপস্থিত বোনেরা আমাকে আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানালেন। আমার জীবনে এই প্রথম আমি ধর্মপালনকারী মুসলিমদের সাথে পরিচিত হলাম। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, নিজেকে তাঁদের মধ্যে অনেক সহজ ও আপন বলে অনুভব করতে লাগলাম, অথচ খৃষ্টান বান্ধবীদের মদ্যে সর্বদাই নিজেকে আগন্তক ও দূরাগত বলে অনুভব করতাম।
প্রত্যেক রবিবারে আমি আলোচনায় উপস্থিত হতে লাগলাম, সাথে সাথে মুসলিম বোনদের দেওয়া বইপত্র পড়তে লাগলাম। এসকল আলোচনার প্রতিটি মুহূর্ত এবং বইয়ের প্রতি পৃষ্ঠা আমার কাছে ঈশ্বরের প্রত্যাদেশের মত মনে হতে লাগল। আমার মনে হচ্ছিল, আমি সত্যের সন্ধান পেয়েছি। সবচেয়ে অদ্ভূত ব্যাপার হল, সেজদায় রত অবস্থায় আমি স্রষ্টাকে আমার অত্যন্ত কাছে অনুভব করতাম।
আমার পর্দাঃ
দু'বছর আগে যখন ফ্রান্সে আমি ইসলাম গ্রহণ করি তখন মুসলিম স্কুলছাত্রীদের ওড়না বা স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢাকা নিয়ে ফরাসীদের বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে। অধিকাংশ ফরাসী নাগরিকের ধারণা ছিল, ছাত্রীদের মাথা ঢাকার অনুমতি দান সরকারী স্কুলগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখার নীতির বিরোধী। আমি তখনো ইসলাম গ্রহণ করিনি। তবে আমার বুঝতে খুব কষ্ট হত, মুসলিম ছাত্রীদের মাথায় ওড়না বা স্কার্ফ রাখার মত সামান্য একটি বিষয় নিয়ে ফরাসীরা এত অস্থির কেন। দৃষ্যতঃ মনে হচ্ছিল যে, ফ্রান্সের জনগন তাদের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা, বৃহৎ শহরগুলোতে নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি আরব দেশগুলো থেকে আসা বহিরাগতদের ব্যাপারে ব্যাপারে উত্তেজিত ও স্নায়ুপীড়িত হয়ে পড়েছিলেন, ফলে তাঁরা তাঁদের শহরগুলোতে ও স্কুলগুলোতে ইসলামি পোষাক দেখতে আগ্রহী ছিলেন না।
অপরদিকে আরব ও মুসলিম দেশগুলোতে মেয়েদের মধ্যে, বিশেষ করে যবতীদের মধ্যে ইসলামি হিজাব বা পর্দার দিকে ফিরে আসার জোয়ার এসেছে। অনেক আরব বা মুসলিম, এবং অধিকাংশ পাশ্চাত্য জনগনের কাছে এটা ছিল কল্পনাতীত; কারন তাদের ধারণা ছিল যে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রসারের সাথে সাথে পর্দা প্রথার বিলুপ্তি ঘটবে।
ইসলামি পোশাক ও পর্দা ব্যবহারের আগ্রহ ইসলামি পুর্নজাগরণের একটা অংশ। এর মাধ্যমে আরব ও মুসলিম জনগোষ্ঠী সমূহ তাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট, অর্থনৈতিক ও উপনিবেশিক আধিপত্যের মাধ্যমে যে গৌরব বিনষ্ট ও পদদলিত করার প্রতিনিয়ত চেষ্টা করা হচ্ছে।
জাপানী জনগনের দৃষ্টিতে মুসলমানদের পুরোপুরি ইসলাম পালন একধরনের পাশ্চাত্য বিরোধীতা ও প্রাচীনকে আঁকড়ে ধরে রাখার মানসিকতা, যা মেজি যুগে জাপানীদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তখন তারা প্রথম পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসে এবং পাশ্চাত্য জীবনযাত্রা ও পোশাক পরিচ্ছদের বিরোধীতা করে।
মানুষ সাধারনত ভালমন্দ বিবেচনা না করেই যে কোন নতুন বা অপরিচিত বিষয়তের বিরোধীতা করে থাকে। কেউ কেউ মনে করেন যে, হিজাব বা পর্দা হচ্ছে মেয়েদের নিপীড়নের একটি প্রতীক! তাঁরা মনে করেন, যে সকল মহিলা পর্দা মেনে চলে বা চলতে আগ্রহী তারা মূলতঃ প্রচলিত প্রথার দাস। তাদের বিশ্বাস, এ সকল মহিলাদেরকে যদি তাদের ন্যাক্কারজনক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করা যায় এবং তাদের মধ্যে নারীমুক্তি ও স্বাধীন চিন্তার আহ্ববার সঞ্চারিত করা যায় তাহলে তারা পর্দাপ্রথয়া পরিত্যাগ করবে।
এ ধরনের উদ্ভট-বাজে চিন্তা শুধু তাঁরাই করেন যাদের ইসলাম সম্পর্কে ধারনা খুবই সীমাবদ্ধ। ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মবিরোধী চিন্তাধারা তাঁদের মনমগজ এমনভাবে অধিকার করে নিয়েছে যে তাঁরা ইসলামের সার্বজনীনতা ও সার্বকালীনতা বুঝতে একেবারেই অক্ষম। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বের সর্বত্র অগনিত অমুসলিম মহিলা ইসলাম গ্রহণ করছেন, যাদের মধ্যে আমিও রয়েছি। এদ্বারা আমরা ইসলামের সার্বজনীতা বুঝতে পারি।
এত কোন সন্দেহ নেই যে, ইসলামি হিজাব বা পর্দা অমুসলিমদের জন্য একটি অদ্ভূত ও বিস্ময়কর ব্যাপার। পর্দা শুধু নারীর মাথার চুলই ঢেকে রাখে না, উপরন্তু আরো এমন কিছু আবৃত করে রাখে যেখানে তাদের কোন প্রবেশাধিকার নেই, আর এজন্যই তাঁরা খুব অস্বস্তি বোধ করেন। বস্তুতঃ পর্দার অভ্যন্তরে কি আছে বাইরে থেকে তাঁরা তা মোটেও জানতে পারেন না।
প্যারিসে অবস্থান কালেই, ইসলাম গ্রহনের পর থেকে আমি হিজাব বা পর্দা মেনে চলতাম।১ আমি একটা স্কার্ফ দিয়ে আমার মাথা ঢেকে নিতাম। পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে একই রঙের স্কার্ফ ব্যবহার করতাম। হয়ত অনেকে এটাকে নতুন একটা ফ্যাশন ভাবত। বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থানকালে আমি কাল বোরকায় আমার সমস্ত দেহ আবৃত করে রাখি, এমনকি আমার মুখমন্ডল এবং চোখও।
টীকা-১: এখানে ও সামনের আলোচনায় লেখিকা হিজাব বা পর্দা বলতে মুখমণ্ডল ও কবজি পর্যন্ত দুহাত বাদে পুরো শরীর ঢেকে রাখা বোঝাচ্ছেন। পবিত্র কুরআনে ও হাদীসের আলোকে সকল মুসলিম ইমাম ও আলিম একমত যে মেয়েদের সম্পুর্ণ শরীর অনাত্মীয় পুরুষদের থেকে আবৃত করতে হবে, শুধুমাত্র মুখমণ্ডল ও হাত খোলা রাখতে কেউ কেউ অনুমতি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আগে আলচনা হয়েছে।
["আগো আলোচনা" বলতে এখানে যে বইয়ে এই জাপানী মহিলার আত্মকথা এসেছে সে বইয়ের পূর্বের আলোচনা বোঝানো হয়েছে।--লেখক]
যখন ইসলাম গ্রহণ করি তখন পাঁচ ওয়াক্ত (নামাজ) আদায় করতে পারব কিনা, অথবা পর্দা করতে পারব কিনা তা নিয়ে আমি গভীরভাবে ভেবে দেখিনি। আসলে আমি নিজেকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতে চাইনি; কারন আমার ভয় হত, হয়ত উত্তর হবে না সূচক এবং তাতে আমার ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত বিঘ্নিত হবে। প্যারিসে মসজিদে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি এমন এক জগতে বাস করেছি যার সাথে ইসলামের সামান্যতম সম্পর্ক ছিল না। নামাজ, পর্দা কিছুই আমি চিনতাম না। আমার জন্য একথা কল্পনা করাও কষ্টকর ছিল যে আমি নামাজ আদায় করছি বা পর্দা পালন করে চলছি। তবে ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা আমার এত গভীর ও প্রবল ছিল যে ইসলাম গ্রহণের পরে আমার কি হবে তা নিয়ে আমি ভাবিনি। বস্তুতঃ আমার ইসলাম গ্রহণ ছিল আল্লাহর অলৌকিক দান। আল্লাহু আকবার।
ইসলামি পোশাক বা হিজাবে আমি নিজেকে নতুন ব্যক্তিত্ব অনুভব করলাম। আমি অনুভব করলাম যে আমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়েছি, আমি সংরক্ষিত হয়েছি। আমি অনুভব করতে লাগলাম আল্লাহ আমার সঙ্গে রয়েছেন।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment