[এই পর্বের প্রায় সবটুকুই "আদর্শ বিবাহ ও দাম্পত্য---আব্দুল হামীদ মাদানী"-বইটি থেকে তুলে দেয়া হয়েছে। তাই আলাদাভাবে রেফারেন্স দিলাম না। মূল বইয়ে অনেক বিস্তারিত থাকায় সেখান থেকে মূল বিষয়গুলো দেয়ার চেষ্টা করেছি। কোন ভুল-ভ্রান্তি হলে দায়িত্ব আমার। মূল লেখকের নয়।]
:::::::::বিবাহের পূর্বে দেশাচার::::::::
১. যেকোন দিন বিবাহের দিন ধার্য করা যায়। এরজন্য কোন দিনকে শুভ বা অশুভ মনে করা ঠিক নয়। পঞ্জিকা দেখে শুভাশুভ দিন নির্বাচন বিদাত এবং বিজাতির অনুকরণ।
২. নিমন্ত্রণপত্রের কোণে হলুদ লাগিয়ে দেয়া বিদআত। এতে কোন শুভলক্ষণ আছে মনে করা শির্ক।
৩. ছেলেমেয়ের পর্দার বিধান লংঘিত হয়ে যায় এমন কোন আচার অনুষ্ঠান যেমন গায়ে হলুদ, "লগন", পান-চিনি ইত্যাদি বৈধ নয়।
৪. পাত্র-পাত্রীকে বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর বাইরে যেতে না দেয়া, এই দিনে মসজিদে বা পীরের থানে সিন্নি বিতরণ অরা প্রভৃতি বিদআত ও শির্ক।
৫. বিভিন্ন অনুষ্ঠান বিধবা নারীদের আসতে না দেয়া ইসলামী প্রথা নয়।
৬. পুরুষ রঙ ব্যবহার করতে পারে না। তাই হাতে-পায়ে মেহেন্দি লাগাতে পারে না। হলুদ ব্যবহার করাও তার জন্য শোভনীয় নয়।
৭. রাতে ক্ষীর মুখে দেয়াও দেশাচার। সম্ভবত এটা অনুপ্রবেশ করা প্রথা। ইসলামী নয়।
৮. গীত-পার্টি, লেডিস ডান্স, অসার ও অশ্লীল মজলিসে কোন মুসলিম নারীর উপস্থিত হওয়া এবং ক্ষীর খাওয়ানো নিঃসন্দেহে হারাম। যেমন মহিলাদের এই কীর্তিকলাপ দর্শন করা বা নাচে ফেরি দেওয়া পুরুষদের জন্য বিশেষভাবে হারাম।
৯. আইবুড়ো বা থুবড়া ভাতের (অবিবাহিত অবস্থার শেষ অন্নগ্রহণের) অনুষ্ঠানো বিজাতীয় প্রথা। এই দিনের ক্ষীর-সিন্নি বিতরনও বিদআত।
১০. বিয়ের অনুষ্ঠানে অপব্যয় বা বিভিন্ন বিষয়ে গোঁ ধরে অযথা জটিলতার সৃষ্টি করা ঠিক নয়।
:::::::::বিবাহ বন্ধন:::::::::::
ইসলামী বিবাহে আকদের সময় ২ টি সাক্ষী জরুরী। পাত্র-পাত্রী যদি বিবাহে কোন শর্ত লাগাতে চায় তা লাগাতে পারে। তবে সে শর্ত যেন কোন হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল না করে।
:::::::::আক্দ কিভাবে হবে?::::::::::
মোহরানা ধার্য ইত্যাদি হয়ে থাকলে কাজী বা ইমাম সাহেব সূক্ষ্ণভাবে খোজ নিবেন যে, অলী কে এবং শরয়ী কিনা? বরের চার স্ত্রীর বর্তমানে এটা পঞ্চম বিবাহ তো নয়? বর মুসলিম তো? পাত্রী ইদ্দতের মধ্যে তো নয়? গর্ভবতী তো নয়? পাত্রের দ্বিতীয় বিবাহ হলে পূর্বের স্ত্রীর বর্তমানে এই পাত্রী তার বোন, ফুপু, বুনঝি বা ভাইঝি তো নয়। এই পাত্রী সধবা হয়ে কারো স্বামীত্বে নেই তো? পাত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ হলে তার পূর্বস্বামী যথারীতি তালাক দিয়েছে তো? পাত্রী রাজী আছে তো? পাত্রীর কোন বৈধ শর্ত তো নেই? দু'জন সঠিক ও উপযুক্ত সাক্ষী আছে কিনা? ইত্যাদি।
অতঃপর সহীহ হাদীসসম্মত খুৎবা পাঠ করবেন। খুতবায় উল্লেখিত আয়াতাদির অনুবাদ পাত্রকে বুঝিয়ে দেওয়া উত্তম। প্রকাশ যে, এ খুৎবা আক্দের জন্য জরুরী নয়, সুন্নত। অতঃপর অলীকে বলতে বলবেন অথবা তার তরফ থেকে ওকীল হয়ে বরের উদ্দেশ্যে একবার বলবেন, "এত টাকা দেনমোহরের বিনিময়ে অমুক গ্রামের অমুকের কন্যা অমুকের (স্পষ্ট নাম উল্লেখ করে) তোমার সহিত বিবাহ দিচ্ছি।"
পাত্র বলবে, "আমি এই বিবাহ কবুল করছি।"
এরপর সকলে বরের উদ্দেশ্যে একাকী এই দুআ করবে, [যার অর্থ]
"আল্লাহ তোমার প্রতি বরকত বর্ষণ করুন, তোমাকে প্রাচুর্য দান করুন এবং তোমাদের উভয়কে মঙ্গলের মাঝে একত্রিত করুন।"
বাহ্যিক আড়ম্বরহীন ইসলামে এইখানে বিবাহের আসল কর্ম শেষ।
বর্তমানের ইয্ন নেওয়ার অনুষ্ঠান এবং উকীল ও সাক্ষী সহ কনের ইয্ন আনতে যাওয়ার ঘটনার সমর্থন শরীয়তে মিলে না। বিবাহ আক্দের জন্য সাক্ষী জরুরী, কনের ইয্নের জন্য নয়। এর জন্য কনের অভিভাবকই যথেষ্ঠ। অবশ্য অভিভাবকের পক্ষ থেকে ধোকা বা খেয়ানতের আশংকা থাকলে কাযী নিজে অথবা তাঁর প্রিতিনিধি পর্দার আড়াল থেকে কনের মতামত জানবে।
ইমাম বা কাজীকে খুশী হয়ে আক্দের পর কিছু উপহার দেওয়া যায়। এখানে দাবী ও জোরের কিছু নেই।
বরকনে নিজে পায়ে হেঁটে গাড়ি চাপবে-নামবে। বিকলাঙ্গ হলে মেয়েরা কেউ কনেকে এবং পুরুষে বরকে তুলবে। একান্ত যদি সম্মানের দরকার হয় তবে এই ভাবেই কনেকে মহিলা এবং বরকে পুরুষে চড়িয়ে দেবে। এছাড়া অন্যসব প্রচলিত প্রথা বেহায়ামী ও অবৈধ।
::::::::::কন্যা বিদায়:::::::::
বিদায়ের সময় কন্যাকে তার পিতা-মাতার উচিত যথোপযুক্ত উপদেশ/পরামর্শ দান করা। অতঃপর বেটীজামাইয়ের উদ্দেশ্যে এই দুআ পঠনীয়ঃ [যার অর্থ]
"হে আল্লাহ! ওদের দু'জনের জন্য বরকত দান কর এবং ওদের বাসরে মঙ্গল দান কর।"
:::::::::::বধূবরণ::::::::::::
ইসলামী প্রথায় এই (বাসরের) দিন বা রাত্রে বিবাহের প্রচার বিধেয়। 'দুফ' বাজিয়ে ছোট ছোট বালিকা মেয়েরা শ্লীলতাপূর্ণ গীত গাইবে। এই দিনে ইসলামী গজল গেয়ে আনন্দ করাই বিধিসম্মত; তবে তাতেও যেন শির্ক ও বিদ্আতের গন্ধ না থাকে। এই খুশীতে রেকর্ডের গান, মাইকের গান, ভিডিও প্রদর্শন প্রভৃতি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
আতশ বা পটকাবাজীও বৈধ নয়।
::::::::::::::::::শুভ বাসর::::::::::
বাসর-কক্ষটি হবে মনোরম, সৌরভময়, সুসজ্জিত ও আলোকমন্ডিত। (অবশ্য এতে অপব্যয় করা উচিত নয়।) কক্ষের একপাশে থাকবে কিছু ফলফ্রুট, দুধ অথবা মিষ্টান্ন ও পানি।
বর ওযু করে বাসরে নব সাথীর অপেক্ষা করবে। নববধূকে ওযু করিয়ে সুসজ্জিতা ও সুরভিতা করে ভাবীরা এবং অন্যান্য মহিলারাও এই দুআ বলবে, [যার অর্থ]
"মঙ্গল ও বরকতের উপর এবং সৌভাগ্যের সহিত (তোমার নবজীবনের সূচনা হোক।)"
অতঃপর তাকে বাসর ঘরে ছেড়ে আসবে। পূর্ব হতেই স্বামী বাসরে থাকলে স্ত্রী সশ্রদ্ধ সালাম করে কক্ষে প্রবেশ করবে। স্বামী সস্নেহে উত্তর দেবে এবং উঠে মুসাফাহা করে শয্যায় বসাবে। কুশলাদি জিজ্ঞাসাবাদের পর স্বামী-স্ত্রী মিলে ২ রাকআত নামায পড়বে। তবে স্ত্রী দাঁড়াবে স্বামীর পশ্চাতে। মুসলিম দম্পতির নবজীবনের সূচনা হবে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে। স্বামীর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর নামায পড়াতে তার (বৈধ বিষয়ে) আনুগত্য করার ইঙ্গিত রয়েছে। সুতরাং প্রথমতঃ আল্লাহর ইবাদত ও দ্বিতীয়তঃ স্বামীর আনুগত্য ও খিদমত হল নারীর ধর্ম।
অতঃপর স্বামী দুআ করবে, [যার অর্থ]
"হে আল্লাহ! আমাকে আমার পরিবারে বরকত ও প্রাচুর্য দান কর এবং ওদের জন্যও আমার মাঝে বরকত ও মঙ্গল দান কর। হে আল্লাহ! যতদিন আমাদেরকে একত্রিত রাখবে ততদিন মঙ্গলের উপর আমাদেরকে অবিচ্ছিন্ন রেখো এবং বিচ্ছিন্ন করলে মঙ্গলের জন্যই আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করো।"
অতঃপর উঠে শয্যায় বসে স্বামী স্ত্রীর ললাটে হাত রেখে "বিসমিল্লাহ" বলে এই দুআ পাঠ করবে, [যার অর্থ]
"হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট এর মঙ্গল এবং এর মধ্যে তোমার সৃষ্ট প্রকৃতির মঙ্গল প্রার্থনা করছি। আর তোমার নিকট এর অমঙ্গল এবং এর মধ্যে তোমার সৃষ্ট প্রকৃতির অমঙ্গল হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।"
অতঃপর সপ্রেমে কোলে টেনে নিয়ে একটা চুম্বন দিয়ে স্বামী স্ত্রীকে বলবে, "আমাকে পেয়ে খুশী হয়েছ তো প্রিয়?" স্ত্রী লজ্জা ও ভয় কাটিয়ে বলবে, "আলহামদুলিল্লাহ, খুব খুশী হয়েছি। আপনি খুশী তো?" স্বামী বলবে, "আলহামদুলিল্লাহ, শত খুশী।"
তারপর দুধ, ফল বা মিষ্টি নিয়ে একে অপরকে খাইয়ে দেবে। এইভাবে নববধূর মন থেকে ভয় ও লজ্জা ধীরে ধীরে দূরীভূত হবে। উদ্বেলিত হবে প্রেমের তরঙ্গমালা।
এই সময় শুধু যৌন চিন্তাই নয় বরং ভাবী জীবনের বহু পরিকল্পনার কথাও উভয়ে আলোচনা করবে। এক অপরকে বিশেষ উপদেশ ও পরামর্শ দেবে।
সতর্কতার বিষয় যে, এই রাত্রে বা অন্য কোন সময়েও পরস্পরের পূর্বেকার ইতিহাস জানতে না চাওয়াই উভয়ের জন্য উত্তম। নচেৎ মধুরাত্রি বিষরাত্রিতে পরিনত হবে।
[বাসর নিয়ে আর এগুবার কোন যৌক্তিক কারনে খুজে পাচ্ছি না বলে এখানেই ইতি টানলাম। ]
উল্লেখ্য যে, বাসরে বর-কনের কথোপকথনে কানাচি পাতা হারাম। কানাচি পেতে গোপন কথা যে শোনে, কিয়ামতে তার কানে গলিত সীসা ঢালা হবে।
নব-দম্পতির প্রেমের জোয়ার প্লাবিত করুক তাদের জীবন ও যৌবনের উভয় কূলকে। এতে অপরের কাজ কি?
[আলহামদুলিল্লাহ! এই লেখাটি আমি শেষ করতে পেরেছি। যারা আগের পর্বগুলো দেখতে উৎসাহী তারা কষ্ট করে আমার নোট সেকশনে ঢুঁ মারুন। ধন্যবাদ।]
No comments:
Post a Comment