Featured Post

I SAID NO TO QUANTUM METHOD

পূর্বে পোস্ট আকারে প্রকাশিত। কারও সাথে ঝগড়া করার জন্য এটা দেইনি। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। কেউ মানতে না পারলে আমার কিছু করার নেই।  আ...

Saturday, October 11, 2014

খুটি


সে অনেকদিন আগের কথা। তখন শহর বলতে তেমন কিছু ছিল না। সবাই গ্রামেই থাকত। পায়ে হাটা রাস্তাগুলো বর্ষাকালে কাদায় মাখামাখি হয়ে যেত আর শীতকালে ধূলি ধূ ধূ করত। সন্ধ্যার দুই এক ঘন্টা পরেই গ্রামগুলো সুনসান হয়ে যেত। দু-এক ঘরে কুপি/হারিকেন জ্বলত। মানুষের বিনোদন বলতে এখনকার মত টিভি-সিনেমা ছিল না। দিনের বেলায় হই হুল্লোড়, পুকুরে-নদীতে সাতরে কে কত দূর যেত পারে, ডুব দিয়ে কে কতক্ষন থাকতে পারে, নৌকা বাইচে কে জেতে কে হারে, হাডুডু, দাড়িয়া বান্ধা এইসব আর রাতের বেলায় টোডা দিয়ে মাছ মারা, শীতের রাতে মুরুব্বীদের পুথিপাঠ আসরের ফাকে ফাকে দুরন্ত ছেলেপেলের খেজুরের রস চুরি- এই সবই ছিল গ্রাম্য মানুষদের দৈনন্দিক আত্নিক খোরাক। তবে অতিদুষ্ট ছেলেপেলের কথা আলাদা। 


আমার নানীর বড় ভাই ছিলেন এমনি একজন। গল্পের খাতিরে ধরা যাক তার নাম ওসমান। কয়েকজন মিলে তাদের একটা গ্রুপ ছিল। আরো ধরা যাক সেই গ্রুপে ছিল সুরুজ, ইন্দ্র, সতীশ, সুলেমান, রনি, পিন্টু, কামাল, কফিল মিয়া। গ্রাম দাপিয়ে বেড়ানোই ছিল সেই গ্রপের কাজ। এখনকার শহুরে যুবকেরা গভীর রাতে হোন্ডা/কার রেসের মাধ্যমে তাদের পৌরুষের পরিচয় দেয়। তখনকার যুবকেরা গভীর রাতে নানাবিধ অপকর্মের মাধ্যমে তারা যে "ডরায় না" তা বুঝিয়ে দিত।

সুরুজের বাপের পয়সা কড়ি একটু বেশি থাকায় সে সব জায়গায় মাতব্বরী করতে চাইত। অন্যেরা তাতে তেমন কোন আপত্তি করত না। ফাউ ফাউ যদি বিড়ি খাওয়া যায় মন্দ কি! কোন এক অলস বিকেল বেলায় তালতলায় বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলঃ 

+ কিরে ইন্দ্র, মুখ শুকনা কেরে? মায় খাওন দিছে না???
[ইন্দ্র মা ভীষন বদরাগী ছিল। ইন্দ্র কোন কাজ করত না বলে প্রায়ই খাওয়া দিত না]
-আজাইরা কতা কইস না কামাইল্যা। খাইত দিত না কেরে??
+ তাইলে কি রুনু দৌড়ানি দিছে? 
[রুনুকে ইন্দ্র পছন্দ করত। কিন্তু বলতে পারত না। সারাক্ষনই ওদের বাড়ীর আসে পাশে ঘুড়াঘুড়ি করত]
-মুখ খারাপ করাইস না কইলাম।
+তুই করবি মুখ খারাপ??? সারাদিন মাইয়্যার পিছে পিছে ঘুরস, কিছু কইতারস না আর তুই করবি মুখ খারাপ?? তর হেই সাহস আছে????
- সাহসের কথা কইস না। আমার মত লাইঠ্যাল এই দেশ্য কেউ আছে?
+ বাপের নাম ভাঙ্গাইয়া আর কত খাবি। নিজে কিছু কর। খালিতো বিলাইয়ের লাহান মিউ মিউ করছ।
-দেখ সুরুইজ্যা, বেশি পট পট করিস না। সাহসের কথা কইতাছস?? ঠিক আছে, কাইল তো আমাবস্যা। কাইল রাইতে শশ্মানে যাইয়া পুরান আম গাছের তলায় যে খুটি গাড়তে পারব হে-ই হইব আসল সাহসী। বুকের পাটা থাকলে রাজি হ! 
+বুকের পাটা লাইয়া যেহেতু কতা রাজিতো হইতেই হইব। অই, তোরা কি কস??
+ হ, হ...আমরা সব যামু। 

পরেরদিন সারাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি। কেউ ঘর থেকে বের হতে পারেনি। সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি থেমে গেলেও ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। রাতের খাওয়া শেষে ধীরে ধীরে সবাই তালতলায় এসে হাজির হল। সবার হাতে গরু বাধার বড় খুটি। দিনের বেলায় যে যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, এই ঘোর অমাবস্যার রাতে শশ্মানে যেতে হবে ভেবে সবারই বুক দুরু দুরু করছিল। আর রাতটাও কেমন যেন একটু অদ্ভুত। সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে তবুও ব্যাঙেরা সব চুপ, অন্যসময় জোনাকির আলোতে অন্ধকার কিছু কাটলেও আজকে জোনাকিরা যেন সব ঘুমুতে গিয়েছে। আকাশটা মেঘে ঢাকা থাকার কারনে তারার আলোও নেই। রাতের পাখিরাও সব পালিয়ে গেল??

তালতলায় বসে কেউ কোন কথা বলছে না। ইন্দ্র তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। সুরুজ হাতের খুটি দিয়ে মাটিতে আচর কাটায় ব্যস্ত। সদাচঞ্চল কামালের মত ভদ্র ছেলে যেন আর পৃথিবীতে নেই। শেষ পর্যন্ত ওসমানই নিরবতা ভাঙে,

+ ল যাই, আর কতক্ষন বইয়া থাকমু??
- হ আয়... বলেই সতীশ উঠে দাঁড়ায়। 

অনিচ্ছাসত্বেও যেন সবাই উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। শশ্মান তালতলা থেকে খুব বেশি দূরে না। বড়জোড় পাচশ গজ হবে। এই রাস্তাটুকুই যেন আজকে আর ফুরোতে চায় না। হঠাৎ দূর থেকে কুকুরের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। ওসমানের ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ইন্দ্র তার পাশেই ছিল। খপ করে ওসমানের হাত চেপে ধরে। ওসমানের মনে হল ইন্দ্র যেন কাপছে। দলের সবারই কম-বেশি একই অবস্থা। 

অবশেষে শশ্মান এসে যায়। ঐতো আমগাছটা দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার রাতে বিশাল আমগাছটাকে আরো বিশাল দেখাচ্ছে। দুনিয়ার সব আধার যেন ঐ ঝাকড়া গাছের মাথায় ভর করেছ। সুরুজ আগে আগে চলছিল। আমগাছটা যখন বিশ কদম দূরে তখন সুরুজ হঠাৎ থেকে গেল। 

+কি হইছে???- সুলেমানের গলা দিয়ে স্বর যেন বেরোচ্ছে না।
-সবাই এইখানে খাড়া। এইখান থেইকা একজন একজন কইরা আমগাছের তলায় একলা যাইয়া খুটি গাইথ্যা আইব। ঠিক আছে?? কফিল তুই আগে যা।
+আমি আগে যাইতাম কেরে?? আমি পরে যামু। আগে আরেকজনরে দে।
-তরা কেউ যাবি আগে?[সবাই নিরুত্তর।] তহনতো কত কথা কইলি। কই গেল তগো সাহস। ঠিক আছে আমিই আগে যাইতাছি।

বলেই সুরুজ তার গলায় ঝোলানো তাবিজে একটা চুমু দিয়ে এগিয়ে যায়। ওসমান যেন দেখতে পাচ্ছে সুরুজ মিয়ার পা কাপছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে সুরুজ আমগাছের নিচে বসে পড়ে। তারপর হাতের খুটি সজোরে মাটিতে গেথে ফেলে। উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসে। কাছে এসে যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে এমনভাবে হাসতে থাকে।

+যা...ডরাইন্নার দল.........সুরুজ ভেংচে উঠে।

সুরুজের কথা শুনে ওসমানের কান গরম হয়ে উঠে। একপ্রকার জোড় করেই ইন্দ্রর হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়। মাত্র বিশ কদম। মনে হচ্ছে কত দূর। ওসমান একবার পিছন ফিরে তাকায় ঐতো সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ওসমান সুরুজের গাথা খুটির কাছে পৌছে যায়। তারপর বসে নিজের হাতের খুটি গেড়ে দিয়েই দৌড়ে চলে আসে। 

+ ইন্দ্র এইবার তুই যা...
- না, আমি পরে যামু...(ইন্দ্রর গলা কেপে যায়)
+ আরে যা, কিছু নাইতো...আমরাতো এহানেই খাড়ায়া রইছি। যা যা...

এরপর আর কথা চলে না। ইন্দ্র ধীর কদমে এগিয়ে যায়। একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। গাছের দিকে তাকিয়েই থাকে।

-কিরে কি হইল...যাস না ক্যান?--পিন্টুর ভয়ার্ত গলা।

ইন্দ্র পিছনে তাকায় না। এগিয়ে যায়। আগের দুই খুটির কাছে যেয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আরো দুই কদম এগিয়ে যায়।হয়ত সে অন্যদের চেয়ে বেশি সাহসী এটাই প্রমাণ করতে চায়। এবার ইন্দ্র বসে পড়ে। খুটিও গেথে ফেলে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসে। একটু এগিয়েই-

"ওরে আমারে ধইরা লাইছে রেএএএএএ........................"

ইন্দ্রর চিৎকারে সবার গায়ের রক্ত পানি হয়ে যায়। তীব্র আতংকে সবাই দেখে ইন্দ্র ধুতির কে যেন পিছন থেকে ধরে রেখেছে। এক মুহুর্ত সবাই জমে যায়। ইন্দ্রর চিৎকারে সবার আগে ছুটে যায় সতীশ। সাথে সাথে সবাই ইন্দ্রকে ধরে শশ্মান থেকে বের করে নিয়ে আসে। ইন্দ্র তখনো চিৎকার করেই চলেছে।

ইন্দ্রকে বাচানো যায় নি। তীব্র ভয়ে তার রাতেই জ্বর উঠে যায়। তিনদিন জ্বরে ভুগে সে মারা যায়।
ইন্দ্র নিজের খুটিখানা নিজের ধুতির উপরেই গেথেছিল। সামান্য এই ভুলের মাশুল ইন্দ্র জীবন দিয়ে দিয়ে দিল। 

[ বিঃদঃ- এটা আমার মৌলিক গল্প নয়। আমার কলিগের ভাষ্য থেকে নেয়া। তার কথা মত এই ঘটনা সম্পূর্ন সত্য। ]

No comments: