মাঠের সোনালী আঁশ থেকে পদ্মার পানির যেমন, আমার মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা তেমন, পুরোদস্তুর বাঙ্গালী। বসন্তের বাতাসের মতই উচ্ছল ছিল আমার ছোটবেলার দিনগুলো। আমাদের গ্রামটা ছিল একটি সুশোভিত ফুলবাগানের মত। আমার বাবা-মা, পরিবারের সবাই সেখানে উজ্জ্বল ফুলের মত ছিল। কিন্তু ভূমিকম্প যেভাবে সব ধ্বংস করে দেয় তেমনি আমার জীবনটা একসময় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে আসল।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। যদিও রাজনীতির তেমন কিছু আমার জানা ছিল না, কিন্তু আমার বাবা উদ্বিগ্ন চেহারা আমি ঠিকই দেখতে পেতাম। আমার বাবা পেশায় ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি গ্রামের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এলাকার রাজনৈতিক নেতার প্রায়শই তাকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধমকি দিত। কারন তিনি সবসময় সত্যের পক্ষে অবস্থান নিতেন।
নির্বাচনের কিছুদিন আগে, অস্ত্রের মুখে কয়েকজন লোক আমাদের ভয়ভীতি দেখায় যেন গ্রামের সবাই তাদের দাড় করানো প্রার্থীকে ভোট দেয়। যদি আমরা তা না করি তবে তারা আমার বড় বোনকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করবে বলে হুমকি দেয়। এরপর বাবা কেমন যেন চুপসে যান। তিনি আমার কলেজ পড়ুয়া বোনকে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বাবা জানতেন বিয়ে দিয়ে দিলে তার হয়ত আর লেখাপড়া করা হবে না। মেয়েকে রক্ষায় তার সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না।
তিনি আমাদের বলে দিলেন যেন আমরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি। তাকে ভীত মনে হচ্ছিল। নির্বাচনের দিন আমরা সবাই ঘরে ছিলাম। বাবা পর্যন্ত ভোট কেন্দ্রে যাননি। নির্বাচনের ফলাফল দেবার পর দেখা গেল অন্য প্রার্থী জয়ী হয়েছে। আমরা প্রমাদ গুনলাম। ঘরের সকল বাতি বন্ধ করে আমরা সারারাত জেগে রইলাম। শুধু ছোট্ট একটি মোমবাতি আমাদের ঘর আলোকিত করতে ছিল।
পরেরদিন বিকেল ৩ টার দিকে আমাদের গ্রামে আক্রমণ করা হল। আগুন লাগিয়ে ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট, মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হল। আমরা প্রাণে বেঁচে গেলাম। কিন্তু সহায়-সম্পত্তি সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আমার চোখের সামনে আমারদের বাড়ি, আমার বইপত্র, আমার খেলার পুতুলগুলো ভষ্মীভূত হল। নিজের হাতে লাগানো গোলাপের চারাতে সদ্য কলি এসেছিল। ফুল ফোটার আগেই আমার শখের গাছটি লুট হয়ে গেল। আগুনে পুড়ে আমাদের এক আত্মীয় মারা গেল। আরো অনেকেই আহত হয়েছিল। আমাদের ফুলের মত সুন্দর গ্রামটি নিমিষেই কবরের মত নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রক্তের উৎকট গন্ধে বাতাস দূষিত হয়ে উঠল।
বাবা ভাল করেই জানতেম আমরা আর এখানে টিকতে পারব না। আমরা প্রায় শূন্যহাতে পালিয়ে ভারতে চলে গেলাম। আমাদের জীবন পুরোপুরি বদলে গেল। আমার শিক্ষক পিতা এখানে শ্রমিকের কাজ নিলেন। আর মা অন্যের বাসায় কাজ করতে শুরু করলেন। তারা দু'জন কঠোর পরিশ্রম করে দু'বেলা দু'মুঠো খাবার জোগাড় করতে সক্ষম হলেন। টাকার অভাবে আমি স্কুলে যেতে পারলাম না। আমি জানি না, আমার বড় বোন এখন কোথায় আছে। সে জীবিত আছে, নাকি মরে গেছে তাও জানা নেই। আমার জীবনটা এখন এমনি হয়ে গেল। চারপাশে তাকালে আমার মত অনেককেই দেখতে পাই।
কেন আমার জীবনটা এমন হল? কেন আমাদের ঘরবাড়ি ছাড়া হতে হল? কেন অন্য একটি দেশে পালিয়ে যাওয়াই ছিল একমাত্র উপায় যে দেশ কখনোই আমাদের দেশের মত নয়? আমার বাবার সকল আশা-ভরষা ভেঙে গেল; মায়ের ভালবাসা দিয়ে বানানো ঘর ধ্বংস হল; আমার বোন হারিয়ে গেল; আর আমি উদ্বাস্তু হয়ে গেলাম। কেন? কাকে জিজ্ঞেস করব? কেউ কি উত্তর দিতে পারবে?
------------------------------ --রিতু প্রজ্ঞা সাহা-------------------------- -----------
Ritu Progga Saha is a student of class X at S.F.X. Greenherald Internation School, Dhaka.
[ডেইলি স্টারের শাউট-জানুয়ারী ৩০, ২০১৪ থেকে অনূদিত]
No comments:
Post a Comment