[অনেকদিন থেকেই এই পোস্ট দেবার ইচ্ছে ছিল। মাল-মসলা পাচ্ছিলাম না। দু-একদিন আগে একটি বই হাতে এসেছে যেখানে আমার বলতে চাওয়া কথাগুলো সুন্দরভাবে গুছিয়ে লেখা আছে। বইতে কোন রেফারেন্সের উল্লেখ্য করা হয় নি। কাজেই আমি রেফারেন্স হিসেবে শুধু বইটির নাম ব্যবহার করব। এরপরও কারো রেফারেন্স প্রয়োজন হলে নিজ দায়িত্বে অনুসন্ধান করে নেবেন।
হ্যা, মুসলিমদের হাতিয়ার হল দোয়া। আল্লাহুর কাছে চাওয়া। আল্লাহু তায়ালা যদি আমাদের সাহায্যকারী হন, তাহলে কে আছে আমাদের ক্ষতিসাধন করতে পারে? আর আল্লাহু তায়ালা যদি আমাদের সাহায্য না করেন তবে কে এমন আছে যে আমাদের সহায়তা করতে পারে? কাজেই আমাদের সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহুর দিকে মুখ ফেরানো উচিত। নিশ্চয়ই আল্লাহু তায়ালার অসাধ্য কিছুই নেই।]
কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে দোয়ার গুরুত্ব, ফযীলত ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বহু জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করেন "তোমরা আমার নিকট দোয়া কর, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব।"
রসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেনঃ "সবচেয়ে বড় এবাদত হল দোয়া।"
অন্য রেওয়ায়েতে আছে; "যে ব্যক্তির দোয়া করার তওফীক হয়ে গেল, তার জন্য কবুলিয়াতের দরজা খুলে গেল।"
তিনি আরও বলেনঃ "আল্লাহ্ তা'আলার দরবারে যে সব জিনিস প্রার্থনা করা হয় তার মধ্যে সুখ-শান্তির দোয়াই হল সবচেয়ে প্রিয়।" এর দ্বারা বুঝা গেল, যে দুনিয়াবী প্রয়োজনের কথাও প্রার্থনা করার হুকুম আছে।"
তিনি আরও এরশাদ করেনঃ "তকদীরের ফয়সালাকে শুধুমাত্র দোয়াই পরিবর্তন করতে পারে।"
দোয়া সকল বিপদ আপদে উপকারী। ঐসকল বিপদাপদেও দোয়া উপকারো যা এখনো অবতীর্ণ হয়নি। অনেক সময় দেখা যায় যে, কখনো বিপদ নেমে আসে কিন্তু অপরদিক হতে দোয়া তার সাথে মিলিত হয় এবং কেয়ামত পর্যন্ত উভয়ের মাঝে দ্বন্দ চলতে থাকে। এর দ্বারা জানা গেল যে, দোয়া সকল সতর্কতা ও কৌশলের চেয়েও বেশি উপকারী? একথাও বুঝা গেল যে, মুছিবতের পূর্বেও দোয়া করতে থাকবে, ফলে দোয়ার বরকতে আশা করা যায় মসিবত আসবে না।
উক্ত আলোচনার দ্বারা একথাও স্পুষ্ট বোঝা গেল যে, অনেক সময় দোয়া কবুলের ফলে কোন বিপদ ঘটে না। সুতরান দোয়া করে তার ব্যপারে কোন খারাপ ধারনা করা উচিত নয়। চাই উক্ত দোয়া কবুল হয়েছে বলে জানা যাক বা জানা না থাকে।
রসুলুল্লাহ (সাঃ) আরো এরশাদ করেন, "আল্লাহ তা'লার নিকট দোয়ার চেয়ে অধিক সম্মানী এবং অধীক মর্যাদাবান আর কোন জিনিস নেই।"
তিনি এরশাদ করেন, যে ব্যক্তির নিকট ইহা পছন্দ হয় যে, আল্লাহ তা'আলা বিপদাপদের সময় তার দোয়া কবুল করুক, তবে সে যেন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময় বেশি বেশি দোয়া করে।
এতে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, মসিবতবিহীন অবস্থার দোয়ার প্রভাব মুসিবতের সময় প্রকাশ পায়।
তিনি আরো এরশাদ করেন যে, "দোয়ার মধ্যে হিম্মতহারা হয়ো না, কেননা দোয়া করে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয় না।"
তিনি আরো বলেন যে, "দোয়া মুসলমানের হাতিয়ার, দ্বীনের খুটি এবং আসমান ও যমীনের নূর।"
একবার রসুলুল্লাহ (সাঃ) একটি বিপদগ্রস্থ সম্প্রদায়ের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, "এরা আল্লাহ্ তা'আলার নিকট কেন দোয়া করে না? এমন কোন মুসলমান নেই যে দোয়ার মধ্যে মনোযোগ দেয় আর সে দোয়াকৃত জিনিস পায় না। চাই সরাসরি তাক দিয়ে দেয়া হোক আর ভবিষ্যতের জন্য তা জমা করে রাখা হোক।"
এর দ্বারা বোঝা গেল যে, দোয়া তো অবশ্যই কবুল হয়। কিন্তু তার অবস্থা বিভিন্ন রকম। যেমন-
(ক) কখনো হুবহু দোয়াকৃত জিনিসটি পাওয়া যায়,
(খ) আবার কখনো তা জমা করে রাখা হয়,
(গ) কখনো দোয়ার বরকতে বিপদ দূর হয়ে যায়।
****দোয়ার ব্যাপারে বেশ কয়েকটি ত্রুটি দেখা যায়ঃ ****
১. একান্ত অসুবিধার সম্মুখিন না হলে দোয়ার প্রতি মনোযোগী না হওয়া
২. এমন সময়েও আল্লাহ্ তা'আলা ও তাঁর রাসূলের শিক্ষা দেওয়া দোয়া ছেড়ে নতুন নতুন দোয়া অযীফা পড়া।
৩. অর্থের দিকে লক্ষ্য করে মনোযোগ সহকারে দোয়া না করা।
৪. দোয়া কবুল হওয়ার আশা এবং বিশ্বাস না রাখা।
৫. দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা এবং দেরী হলে বিরক্ত হয়ে দোয়া ছেড়ে দেওয়া।
এসকল ত্রুটি ও অসতর্কতা দূর করার উদ্দেশ্যে যুক্তিযুক্ত মনে হল যে, যে সকল গুরুত্বপূর্ণ দোয়া কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকে একত্রিত করে দেওয়া হোক, কেননা এসকল দোয়া অন্যান্য দোয়া অপেক্ষা কয়েকটি দিকে থেকেই প্রাধান্য পায়।
১. যখন হাকীম নিজেই আরজী পেশ করার ভাষা বলে দেন তখন মঞ্জুর হওয়ার ক্ষেত্রে কোন সন্দেহ থাকে না। এমনিভাবে যে সকল দোয়া আল্লাহ তা'আলা নিজেই শিক্ষা দিয়েছেন তার কবুল হওয়ার উপযুক্ত।
২. উক্ত দোয়াগুলিতে যে পরিমানে দ্বীনী ও দুনিয়াবী জরুরতের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে, যদি আমরা কেয়ামত পর্যন্তও চিন্তা করি তবুও এমন দোয়ার ভাষা প্রনয়ণ আমাদের দ্বারা সম্ভব হবে না।
৩. অনেক সময় দোয়ার ভাষা আদবের খেলাফ হয়ে যায়। যার ফলে উক্ত দোয়া মসিবতের কারণ হয় দাঁড়ায়। যেমন- কোন সাহাবী ধৈর্য্যের দোয়া করেছিলেন তখন হুযুর (সাঃ) এরশাদ করলেন যে, তুমি তো বিপদের জন্য দোয়া করলে। কেননা যখন বিপদ আসবে তখনই তো বেশি বেশি ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। আরেক সাহাবী দোয়া করেছিলেন, আখেরাতে আমার যত শাস্তি হওয়ার কথা আছে আয় আল্লাহ সে সব শাস্তি আমাকে দুনিয়াতেই দিয়ে দাও। একথা শুনে রসুলুল্লাহ (সাঃ) তাকে এরূপ দোয়া না করার জন্য সতর্ক করে দিলেন।
এমনিভাবে কোন এক সাহাবীপুত্র জান্নাতের ডানদিকে সাদা বালাখানার আবেদন জানিয়েছিলেন তখন তার পিতা তাকে সংশোধন করে দিয়েছিলেন। মোটকথা নিজের খেয়াল-খুশি এবং ইচ্ছামতো দোয়া প্রণয়ন করলে এ জাতীয় সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। আর যে সকল দোয়া কুরআন-হাদীসে বর্ণিত তা এ ধরনের সমস্যামুক্ত।
সবচেয়ে উত্তম তো এটাই যে, কুরআন-হাদীসের দোয়াগুলি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে হুবহু সেভাবেই পাঠ করা।
****দোয়ার আদবসমূহ*****
১. যেকোন কাজ একমাত্র আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির জন্য করা (অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়)
২. পানাহার, পরিধান ও উপার্জনের মধ্যে হারাম বস্তু পরিত্যাগ করা।
৩. দোয়া করার পূর্বে যে কোন নেক আমল করা।
৪. পাক-পবিত্র এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া।
৫. ওযু করা।
৬. কেবলামুখী হওয়া
৭. দোয়া করার পূর্বে নফল নামায পড়া।
৮. দোয়ার পূর্বে ও পরে আল্লাহ্ তা'আলার প্রশংসা করা।
৯. দোয়ার পূর্বে ও পরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর দরূদ পাঠ করা।
১০. দোয়া করার সময় আদবের সহিত থাকা।
১১. কাকুতি-মিনতির সাথে দোয়া করা।
১২. নিজের দীনতা-হীনতা ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করা।
১৩. আল্লাহ তা"আলার গুণবাচক নামের ওসিলা দিয়ে দোয়া করা।
১৪. দোয়ার মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে ছন্দযুক্ত বাক্য ব্যবহার করা হতে বিরত থাকা।
১৫. দোয়ার মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে সুর অবলম্বণ করা হতে বিরত থাকা।
১৬. নবী-রাসূলদের ওসিলা দিয়ে দোয়া করা।
১৭. অনুচ্চস্বরে দোয়া করা।
১৮. নিজ গোনাহের স্বীকারোক্তির সাথে দোয়া করা।
১৯. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে যে সব দোয়া বর্ণিত রয়েছে সেগুলো অবলম্বণ করা।
২০. দোয়ার আরম্ভ নিজে থেকে করা। অতঃপর নিজ মা, বাপ এবং অন্যান্য মুমিম ভাইদের জন্য দোয়া করা।
২১. শুধু নিজের জন্য নয়, বরং সকলের জন্য দোয়া করা।
২২. পূর্ণ একীন ও নিশ্চয়তার সাথে দোয়া করা।
২৩. অত্যন্ত আগেব ও আগ্রহের সাথে দোয়া করা।
২৪। অন্তরের অন্তঃস্থল হতে পূর্ণ উদ্যমের সাথে দোয়া করা।
২৫. একই মকছুদের জন্য বার বার দোয়া করা।
২৬. কোন গোনাহ অথবা আত্মীয়তা বিচ্ছেদের জন্য দোয়া না করা।
২৭. দোয়ার মধ্যে সীমালংঘন না করা (অসম্ভব কিছু না চাওয়া)।
২৮. দোয়াকারী ও দোয়া শ্রবণকারী উভয়ে সম্মিলিত মুনাজাতে নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী দোয়া করা।
২৯. দোয়া শেষ করার পর উভয় হাত মুখমন্ডলের উপর ফেরানো।
৩০. দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করা।
****যখন দোয়া কবুল হয়***
১. কদরের রাত্রি (শবে কদর) রমযানের শেষ দশদিনে বেজোড় রাত্রিগুলি, (২১,২৩,২৫,২৭ ও ২৯ তম রাত্রি) তবে এর মধ্যে ২১ ও ২৭তম রাত্রে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভবনা সর্বাধিক।
২. আরাফার পূর্ণদিন (যিলহজ্জের নবম তারিখ)
৩. রমযান মাস।
৪. জুমার রাত্রি।
৫. জুমার দিন।
৬. রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ।
৭. সাহরীর সময়।
*******যে অবস্থায় দোয়া কবুল হয়*****
১. নামাযের আযান হওয়া কালীন
২. আযান ও একামতের মধ্যখানে
৩. কোন ব্যাক্তি বালা-মুসিবতের মধ্যে পতিত হলে।
৪. জেহাদের ময়দানে কাতারবন্দী অবস্থায় দোয়া করলে।
৫. ফরয নামাযে পর।
৬. কোরআনে করীমের তেলাওয়াত হতে ফারেগ হওয়ার পর।
৭. কোরআনে করীমের খতমের পর।
৮. যমযমের পানি পান করার সময়
৯. মৃত্যু শয্যায় শায়িত ব্যক্তির প্রাণ বাহির হওয়ার সময়।
১০. মুসলমানদের ধর্মীয় সমাবেশে।
১১. যিকিরের মজলিসে।
১২. মৃত ব্যক্তির চক্ষু বন্ধ করার সময় দোয়া করলে।
১৩. বৃষ্টি বর্ষণের সময়।
১৪. কা'বা শরীফের প্রতি দৃষ্টি পড়ার সময়।
*****যেখানে দোয়া কবুল হয়***
১. মাতাফের মধ্যে। ২. মুলতাযামের নিকট
৩. মিযাবের নিচে (কাবা শরীফের ছাদের পানি নির্গত হবার স্থানে)
৪. বায়তুল্লাহর ভিতরে। ৫. যমযম কুপের নিকটে। ৬. সাফা পাহাড়ের উপর।
৭. মারওয়া পাহাড়ের উপর। ৮. মাস'য়া (ছায়ী করার স্থান) এর মধ্যে।
৯. মাকামে ইব্রাহিমের পিছনে। ১০. আরাফাতের ময়দানে। ১১. মুযদালিফার মধ্যে।
১২. মীনার মধ্যে। ১৩. মিনায় অবস্থিত (শয়তানকে পাথর) তিনটি স্তম্ভের নিকট।
১৪. রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর রওজা শরীফের নিকট।
**** যাদের দোয়া কবুল হয় ****
১. বিপদগ্রস্থ ও অসহায় ব্যক্তির দোয়া।
২. মযলুম (অত্যাচারিত) ব্যক্তির দোয়া।
৩. নিজ সন্তানের জন্য পিতার দোয়া।
৪. ন্যায়পরায়ন রাস্ট্রপ্রধানের দোয়া।
৫. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারকারীর দোয়া।
৬. প্রত্যেক নেক্কার ব্যক্তির দোয়া।
৭. মুসাফিরের দোয়া।
৮. ইফতারের সময় রোযাদার ব্যক্তির দোয়া।
৯. এক মুসলমানের অপর মুসলমান ভাইয়ের জন্য তার অসাক্ষাতে দোয়া করলে।
[দোয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সীমাহীন অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। যতটুকুও বা করি দায়সারাভাবে, প্রাণ নেই তাতে। আমাদের পূর্ববর্তীরা দোয়ার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান করতেন। আমরাও যদি ঠিকমত দোয়া করতে পারি তাহলে আল্লাহ তা’আলার গায়েবী সাহয্য ও মদদের ভাগিদার হতে পারব। আল্লাহ তা’আলা আমাদের আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
রেফারেন্সঃ মুনাজাতে মকবুল বা হিযবুল বাহার। লেখকঃ মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ)]
হ্যা, মুসলিমদের হাতিয়ার হল দোয়া। আল্লাহুর কাছে চাওয়া। আল্লাহু তায়ালা যদি আমাদের সাহায্যকারী হন, তাহলে কে আছে আমাদের ক্ষতিসাধন করতে পারে? আর আল্লাহু তায়ালা যদি আমাদের সাহায্য না করেন তবে কে এমন আছে যে আমাদের সহায়তা করতে পারে? কাজেই আমাদের সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহুর দিকে মুখ ফেরানো উচিত। নিশ্চয়ই আল্লাহু তায়ালার অসাধ্য কিছুই নেই।]
কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে দোয়ার গুরুত্ব, ফযীলত ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বহু জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা'আলা এরশাদ করেন "তোমরা আমার নিকট দোয়া কর, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব।"
রসুলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেনঃ "সবচেয়ে বড় এবাদত হল দোয়া।"
অন্য রেওয়ায়েতে আছে; "যে ব্যক্তির দোয়া করার তওফীক হয়ে গেল, তার জন্য কবুলিয়াতের দরজা খুলে গেল।"
তিনি আরও বলেনঃ "আল্লাহ্ তা'আলার দরবারে যে সব জিনিস প্রার্থনা করা হয় তার মধ্যে সুখ-শান্তির দোয়াই হল সবচেয়ে প্রিয়।" এর দ্বারা বুঝা গেল, যে দুনিয়াবী প্রয়োজনের কথাও প্রার্থনা করার হুকুম আছে।"
তিনি আরও এরশাদ করেনঃ "তকদীরের ফয়সালাকে শুধুমাত্র দোয়াই পরিবর্তন করতে পারে।"
দোয়া সকল বিপদ আপদে উপকারী। ঐসকল বিপদাপদেও দোয়া উপকারো যা এখনো অবতীর্ণ হয়নি। অনেক সময় দেখা যায় যে, কখনো বিপদ নেমে আসে কিন্তু অপরদিক হতে দোয়া তার সাথে মিলিত হয় এবং কেয়ামত পর্যন্ত উভয়ের মাঝে দ্বন্দ চলতে থাকে। এর দ্বারা জানা গেল যে, দোয়া সকল সতর্কতা ও কৌশলের চেয়েও বেশি উপকারী? একথাও বুঝা গেল যে, মুছিবতের পূর্বেও দোয়া করতে থাকবে, ফলে দোয়ার বরকতে আশা করা যায় মসিবত আসবে না।
উক্ত আলোচনার দ্বারা একথাও স্পুষ্ট বোঝা গেল যে, অনেক সময় দোয়া কবুলের ফলে কোন বিপদ ঘটে না। সুতরান দোয়া করে তার ব্যপারে কোন খারাপ ধারনা করা উচিত নয়। চাই উক্ত দোয়া কবুল হয়েছে বলে জানা যাক বা জানা না থাকে।
রসুলুল্লাহ (সাঃ) আরো এরশাদ করেন, "আল্লাহ তা'লার নিকট দোয়ার চেয়ে অধিক সম্মানী এবং অধীক মর্যাদাবান আর কোন জিনিস নেই।"
তিনি এরশাদ করেন, যে ব্যক্তির নিকট ইহা পছন্দ হয় যে, আল্লাহ তা'আলা বিপদাপদের সময় তার দোয়া কবুল করুক, তবে সে যেন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময় বেশি বেশি দোয়া করে।
এতে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, মসিবতবিহীন অবস্থার দোয়ার প্রভাব মুসিবতের সময় প্রকাশ পায়।
তিনি আরো এরশাদ করেন যে, "দোয়ার মধ্যে হিম্মতহারা হয়ো না, কেননা দোয়া করে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হয় না।"
তিনি আরো বলেন যে, "দোয়া মুসলমানের হাতিয়ার, দ্বীনের খুটি এবং আসমান ও যমীনের নূর।"
একবার রসুলুল্লাহ (সাঃ) একটি বিপদগ্রস্থ সম্প্রদায়ের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, "এরা আল্লাহ্ তা'আলার নিকট কেন দোয়া করে না? এমন কোন মুসলমান নেই যে দোয়ার মধ্যে মনোযোগ দেয় আর সে দোয়াকৃত জিনিস পায় না। চাই সরাসরি তাক দিয়ে দেয়া হোক আর ভবিষ্যতের জন্য তা জমা করে রাখা হোক।"
এর দ্বারা বোঝা গেল যে, দোয়া তো অবশ্যই কবুল হয়। কিন্তু তার অবস্থা বিভিন্ন রকম। যেমন-
(ক) কখনো হুবহু দোয়াকৃত জিনিসটি পাওয়া যায়,
(খ) আবার কখনো তা জমা করে রাখা হয়,
(গ) কখনো দোয়ার বরকতে বিপদ দূর হয়ে যায়।
****দোয়ার ব্যাপারে বেশ কয়েকটি ত্রুটি দেখা যায়ঃ ****
১. একান্ত অসুবিধার সম্মুখিন না হলে দোয়ার প্রতি মনোযোগী না হওয়া
২. এমন সময়েও আল্লাহ্ তা'আলা ও তাঁর রাসূলের শিক্ষা দেওয়া দোয়া ছেড়ে নতুন নতুন দোয়া অযীফা পড়া।
৩. অর্থের দিকে লক্ষ্য করে মনোযোগ সহকারে দোয়া না করা।
৪. দোয়া কবুল হওয়ার আশা এবং বিশ্বাস না রাখা।
৫. দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা এবং দেরী হলে বিরক্ত হয়ে দোয়া ছেড়ে দেওয়া।
এসকল ত্রুটি ও অসতর্কতা দূর করার উদ্দেশ্যে যুক্তিযুক্ত মনে হল যে, যে সকল গুরুত্বপূর্ণ দোয়া কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকে একত্রিত করে দেওয়া হোক, কেননা এসকল দোয়া অন্যান্য দোয়া অপেক্ষা কয়েকটি দিকে থেকেই প্রাধান্য পায়।
১. যখন হাকীম নিজেই আরজী পেশ করার ভাষা বলে দেন তখন মঞ্জুর হওয়ার ক্ষেত্রে কোন সন্দেহ থাকে না। এমনিভাবে যে সকল দোয়া আল্লাহ তা'আলা নিজেই শিক্ষা দিয়েছেন তার কবুল হওয়ার উপযুক্ত।
২. উক্ত দোয়াগুলিতে যে পরিমানে দ্বীনী ও দুনিয়াবী জরুরতের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে, যদি আমরা কেয়ামত পর্যন্তও চিন্তা করি তবুও এমন দোয়ার ভাষা প্রনয়ণ আমাদের দ্বারা সম্ভব হবে না।
৩. অনেক সময় দোয়ার ভাষা আদবের খেলাফ হয়ে যায়। যার ফলে উক্ত দোয়া মসিবতের কারণ হয় দাঁড়ায়। যেমন- কোন সাহাবী ধৈর্য্যের দোয়া করেছিলেন তখন হুযুর (সাঃ) এরশাদ করলেন যে, তুমি তো বিপদের জন্য দোয়া করলে। কেননা যখন বিপদ আসবে তখনই তো বেশি বেশি ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। আরেক সাহাবী দোয়া করেছিলেন, আখেরাতে আমার যত শাস্তি হওয়ার কথা আছে আয় আল্লাহ সে সব শাস্তি আমাকে দুনিয়াতেই দিয়ে দাও। একথা শুনে রসুলুল্লাহ (সাঃ) তাকে এরূপ দোয়া না করার জন্য সতর্ক করে দিলেন।
এমনিভাবে কোন এক সাহাবীপুত্র জান্নাতের ডানদিকে সাদা বালাখানার আবেদন জানিয়েছিলেন তখন তার পিতা তাকে সংশোধন করে দিয়েছিলেন। মোটকথা নিজের খেয়াল-খুশি এবং ইচ্ছামতো দোয়া প্রণয়ন করলে এ জাতীয় সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা থাকে। আর যে সকল দোয়া কুরআন-হাদীসে বর্ণিত তা এ ধরনের সমস্যামুক্ত।
সবচেয়ে উত্তম তো এটাই যে, কুরআন-হাদীসের দোয়াগুলি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে হুবহু সেভাবেই পাঠ করা।
****দোয়ার আদবসমূহ*****
১. যেকোন কাজ একমাত্র আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির জন্য করা (অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়)
২. পানাহার, পরিধান ও উপার্জনের মধ্যে হারাম বস্তু পরিত্যাগ করা।
৩. দোয়া করার পূর্বে যে কোন নেক আমল করা।
৪. পাক-পবিত্র এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া।
৫. ওযু করা।
৬. কেবলামুখী হওয়া
৭. দোয়া করার পূর্বে নফল নামায পড়া।
৮. দোয়ার পূর্বে ও পরে আল্লাহ্ তা'আলার প্রশংসা করা।
৯. দোয়ার পূর্বে ও পরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর উপর দরূদ পাঠ করা।
১০. দোয়া করার সময় আদবের সহিত থাকা।
১১. কাকুতি-মিনতির সাথে দোয়া করা।
১২. নিজের দীনতা-হীনতা ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করা।
১৩. আল্লাহ তা"আলার গুণবাচক নামের ওসিলা দিয়ে দোয়া করা।
১৪. দোয়ার মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে ছন্দযুক্ত বাক্য ব্যবহার করা হতে বিরত থাকা।
১৫. দোয়ার মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে সুর অবলম্বণ করা হতে বিরত থাকা।
১৬. নবী-রাসূলদের ওসিলা দিয়ে দোয়া করা।
১৭. অনুচ্চস্বরে দোয়া করা।
১৮. নিজ গোনাহের স্বীকারোক্তির সাথে দোয়া করা।
১৯. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে যে সব দোয়া বর্ণিত রয়েছে সেগুলো অবলম্বণ করা।
২০. দোয়ার আরম্ভ নিজে থেকে করা। অতঃপর নিজ মা, বাপ এবং অন্যান্য মুমিম ভাইদের জন্য দোয়া করা।
২১. শুধু নিজের জন্য নয়, বরং সকলের জন্য দোয়া করা।
২২. পূর্ণ একীন ও নিশ্চয়তার সাথে দোয়া করা।
২৩. অত্যন্ত আগেব ও আগ্রহের সাথে দোয়া করা।
২৪। অন্তরের অন্তঃস্থল হতে পূর্ণ উদ্যমের সাথে দোয়া করা।
২৫. একই মকছুদের জন্য বার বার দোয়া করা।
২৬. কোন গোনাহ অথবা আত্মীয়তা বিচ্ছেদের জন্য দোয়া না করা।
২৭. দোয়ার মধ্যে সীমালংঘন না করা (অসম্ভব কিছু না চাওয়া)।
২৮. দোয়াকারী ও দোয়া শ্রবণকারী উভয়ে সম্মিলিত মুনাজাতে নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী দোয়া করা।
২৯. দোয়া শেষ করার পর উভয় হাত মুখমন্ডলের উপর ফেরানো।
৩০. দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করা।
****যখন দোয়া কবুল হয়***
১. কদরের রাত্রি (শবে কদর) রমযানের শেষ দশদিনে বেজোড় রাত্রিগুলি, (২১,২৩,২৫,২৭ ও ২৯ তম রাত্রি) তবে এর মধ্যে ২১ ও ২৭তম রাত্রে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভবনা সর্বাধিক।
২. আরাফার পূর্ণদিন (যিলহজ্জের নবম তারিখ)
৩. রমযান মাস।
৪. জুমার রাত্রি।
৫. জুমার দিন।
৬. রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ।
৭. সাহরীর সময়।
*******যে অবস্থায় দোয়া কবুল হয়*****
১. নামাযের আযান হওয়া কালীন
২. আযান ও একামতের মধ্যখানে
৩. কোন ব্যাক্তি বালা-মুসিবতের মধ্যে পতিত হলে।
৪. জেহাদের ময়দানে কাতারবন্দী অবস্থায় দোয়া করলে।
৫. ফরয নামাযে পর।
৬. কোরআনে করীমের তেলাওয়াত হতে ফারেগ হওয়ার পর।
৭. কোরআনে করীমের খতমের পর।
৮. যমযমের পানি পান করার সময়
৯. মৃত্যু শয্যায় শায়িত ব্যক্তির প্রাণ বাহির হওয়ার সময়।
১০. মুসলমানদের ধর্মীয় সমাবেশে।
১১. যিকিরের মজলিসে।
১২. মৃত ব্যক্তির চক্ষু বন্ধ করার সময় দোয়া করলে।
১৩. বৃষ্টি বর্ষণের সময়।
১৪. কা'বা শরীফের প্রতি দৃষ্টি পড়ার সময়।
*****যেখানে দোয়া কবুল হয়***
১. মাতাফের মধ্যে। ২. মুলতাযামের নিকট
৩. মিযাবের নিচে (কাবা শরীফের ছাদের পানি নির্গত হবার স্থানে)
৪. বায়তুল্লাহর ভিতরে। ৫. যমযম কুপের নিকটে। ৬. সাফা পাহাড়ের উপর।
৭. মারওয়া পাহাড়ের উপর। ৮. মাস'য়া (ছায়ী করার স্থান) এর মধ্যে।
৯. মাকামে ইব্রাহিমের পিছনে। ১০. আরাফাতের ময়দানে। ১১. মুযদালিফার মধ্যে।
১২. মীনার মধ্যে। ১৩. মিনায় অবস্থিত (শয়তানকে পাথর) তিনটি স্তম্ভের নিকট।
১৪. রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর রওজা শরীফের নিকট।
**** যাদের দোয়া কবুল হয় ****
১. বিপদগ্রস্থ ও অসহায় ব্যক্তির দোয়া।
২. মযলুম (অত্যাচারিত) ব্যক্তির দোয়া।
৩. নিজ সন্তানের জন্য পিতার দোয়া।
৪. ন্যায়পরায়ন রাস্ট্রপ্রধানের দোয়া।
৫. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারকারীর দোয়া।
৬. প্রত্যেক নেক্কার ব্যক্তির দোয়া।
৭. মুসাফিরের দোয়া।
৮. ইফতারের সময় রোযাদার ব্যক্তির দোয়া।
৯. এক মুসলমানের অপর মুসলমান ভাইয়ের জন্য তার অসাক্ষাতে দোয়া করলে।
[দোয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সীমাহীন অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। যতটুকুও বা করি দায়সারাভাবে, প্রাণ নেই তাতে। আমাদের পূর্ববর্তীরা দোয়ার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান করতেন। আমরাও যদি ঠিকমত দোয়া করতে পারি তাহলে আল্লাহ তা’আলার গায়েবী সাহয্য ও মদদের ভাগিদার হতে পারব। আল্লাহ তা’আলা আমাদের আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
রেফারেন্সঃ মুনাজাতে মকবুল বা হিযবুল বাহার। লেখকঃ মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ)]
No comments:
Post a Comment