আরাফাত ভাইয়ের বয়সটা বেড়েই চলেছে। ভয়ে হিসেব করেন না। না জানি কত হয়েছে! তবে মনে মনে জানেন, তার পরিবারের লোকজনও জানে যে, তার বয়স ৩০ পেড়িয়ে গেছে আরো অনেক আগেই। দুঃখের বিষয় হল, আরাফাত ভাইয়ের বিয়ে করা হয় নি।
ছাত্র জীবনে লেখাপড়া বেশি ভাল লাগত না। তাই তেমন কোন ডিগ্রীও নেই তার। বাবা সরকারী চাকুরী করেন, সরকারী বাসায় থাকেন-তাই পরিবারের বড় ছেলে হয়েও খুব বেশি দায়িত্ববোধ কাঁধে নেন নি। তাবলীগ তাবলীগ করে কতদিকে সফর করেছেন! বাসা থেকে কাজ করার জন্য সবসময় চাপ দিত। উনি মনের মত কাজ পান না।
বিয়ের বয়স পার হয়ে যায়, চাকুরী মেলে না। বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে অবশেষে একটা চাকুরী উনি পেলেন। সেটাও সরকারী চাকুরী-ই। এখানে বাসা আছে। এবার তাহল বিয়ে করতে হয়।
বিয়ে করতে যেয়ে এবার আর কোন পাত্রীই পাওয়া যায় না। উনার বয়সী তো বটেই, আশেপাশের বয়সী যত মেয়ে আছে সবার তো কবেই বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোট বিয়ে করতে চাইলে ১০-১২ বছরের ছোট হয়ে যায়। মেয়ের ফ্যামিলি রাজি হয় না। এ কোন মুসিবত!
মুশকিল যেমন আছে, আসানও তেমন আছে। আরাফাত ভাইয়ের এই বিপদে এগিয়ে এলেন তারই এক সাথী ভাই। লম্বা সফরে ঐ ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল। সফর শেষ হবার পরও সেই ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ ছিল। কাকতালীয় ভাবে আরাফাত ভাই যেখানে চাকুরী পান মুশফিক সেখানে আগে থেকেই চাকুরী করে। পাত্রী মুশফিকেরই ছোট বোন।
সুমী সবে এইচ এস সি পাশ করেছে। রেজাল্টও ভাল। সুমীর ইচ্ছা আরো লেখাপড়া করার। কিন্তু তার ফ্যামিলির ইচ্ছা অন্যরকম। মুশফিকের আছে আরাফাত ভাইয়ের কথা শুনে সোবহান সাহেব একফাঁকে এসে আরাফাত ভাইয়ের সাথে কথা বলে গেলেন। পাত্র হিসেবে আরাফাত ভাইকে তার খুবই পছন্দ হল। কৌশলে আরাফাত ভাইয়ে পৈত্রিক ঠিকানাটাও সোবহান সাহেব জেনে নিলেন।
সোবহান সাহেব একদিন সময় করে আরাফাত ভাইয়ের বাবা আশরাফ সাহেবের সাথে দেখা করতে আসলেন। আশরাফ সাহেবের সাথে কথা বলেও সোহবান সাহেবের খুব পছন্দ হল। তিনি তাদের সাথে কথা বার্তা একরকম পাকা করেই আসলেন। এখন শুধু তাদের মেয়ে পছন্দ হলেই হল।
সুমী বা আরাফাত ভাই এইসবের কিছুই জানে না। আশরাফ সাহেব একদিন তার স্ত্রীকে নিয়ে সোবহান সাহেবের বাড়িতে আসলেন। সুমীর সাথে পরিচয় করিয়েও দিলেন। কথা বার্তায় সুমী বুঝতে পারল তার বিয়ের কথা বার্তা চলছে। সুমী আশরাফ সাহেবদের সাথে তেমন কোন কথা না বলে গুমোট হয়ে রইল।
মুশফিকের কাছে আরাফাত ভাইয়ের বিবরন শুনে সুমী আরো চিমসে গেল। রাতে শুরু হল তার কান্না। খাওয়া দাওয়াও বন্ধ। সোবহান সাহেব বিচলিত হলেন না। তিনি মেয়েকে সাফ জানিয়ে দিলেন, এখানেই তাকে বিয়ে দেয়া হবে। তিনি কথা দিয়ে ফেলেছেন। মিসেস সোবহান এসে মেয়েকে অনেক বোঝালেন। সুমী উল্টোদিকে শুয়ে শুধু কাদছে। রাতে একবার সুইসাইড করার চেষ্টা করল সুমী। কিন্তু ওড়না ছিড়ে যাওয়ায় কোমড়ে ব্যথা পাওয়া ছাড়া আর কোন লাভ হল না।
আরাফাত ভাইকে ফোন দিয়ে আশরাফ সাহেব শুধু এতটুকুই বললেন, পাত্রী পাওয়া গেছে, বাড়ি এসো।
আরাফাত ভাই বাড়ি এসেই শোনেন আগামী শুক্রবার তার বিয়ে। আজ বাদে কাল বৃহস্পতি, তারপরই শুক্রবার!
আরাফাত ভাই মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। অবস্থাদৃষ্টেতো মনে হচ্ছে উনার মতামতের কোন গুরুত্ব দেয়া হবে না। থাক, মেয়ের ফ্যামিলি, মেয়ে রাজি থাকলেই হয়। মিসেস আশরাফ এই ব্যাপারে ছেলেকে আশ্বস্থ করলেন।
যথাসময়ে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। সুমীকে নিয়ে আসা হল সেদিনই। সারাপথ সুমী কারো সাথে কোন কথা বলেনি। খাওয়া-দাওয়াও করেনি। বিস্ময়ের ব্যাপার হল কান্নাকাটিও করেনি।
বাসর ঘরে যখন আরাফাত ভাই ঢুকলেন তখন তার পড়নে ভারী পাঞ্জাবী। সারাদিনের ধকলে ক্লান্তও বটে। এদিকে চারদিক ফুলের গন্ধে ম ম করছে। আরাফাত ভাইয়ের মাথা ধরে গেছে।
ঘরের ঢোকার সময় সালাম দেয়ার দরকার ছিল। টেনশনে ভুলে গিয়েছেন। এখন কি দিবেন? ইতস্তত করে দিয়েই ফেললেন। সেই সালামের জবাব আরাফাত ভাইয়ের কান পর্যন্তই পৌছাল না।
আগে গোসল দেয়া দরকার। ড্রয়ার থেকে টান দিয়ে লুঙ্গি আর গামছে নিয়ে আরাফাত ভাই বাথরুমে ঢুকে গেলেন। কোমড়ে গামছা পেচিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন শাওয়ারের নিচে। টানা দশমিনিট ভেজার পর শরীর যেন একটু ঠান্ডা হল। এরপর সাবান আর শ্যাম্প মেখে আবারো দশমিনিট শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে আরাফাত ভাই একটু ধাতস্থ হলেন।
পাঞ্জাবীটা ঘামে চিট চিট করছে। পড়তে আর রুচি হচ্ছে না। আরাফাত ভাই লুঙ্গি আর পাতলা একটা গ্যাঞ্জি পড়ে বেড়িয়ে আসলেন। গ্যাঞ্জির উপর দিয়ে হালকা ভুড়ির ভাব লক্ষ করে আরাফাত ভাই একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন।
সুমী তখনো পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে বসে আছে। আরাফাত ভাই মৃদু একটু কাশলেন। সুমীর তাতে কোন ভাবান্তর হল না। আরাফাত ভাই নার্ভাস হয়ে গেলেন। তাবলীগ করার কারনে তিনি কখনই মেয়েদের ধারা-কাছে যান নি। আর মেয়েরাও তাকে দেখলে অন্যদিকে সরে যেত। কাজেই নিতান্তই অপরিচিত একজন মেয়ের সাথে কিভাবে কথা বলবেন ভেবেই পেলেন না।
উপায়ান্তর না দেখে আরাফাত ভাই জায়নামাজে দাড়িয়ে গেলেন। নামায শেষে নাতিদীর্ঘ দোয়া করলেন। এবার যেন একটু আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন।
ভাবলেন আমার এতক্ষন যেমন লাগছিল মেয়েটারও তো তেমন লাগতেই পারে। তিনি খড়খড় করে গলাটা পরিষ্কার করে বললেন,
"ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিন। ভাল লাগবে..."
সুমী চুপ।
আরেকবার চেষ্টা করা যাক।
"নাকি কিছু খাবেন? ক্ষুধা লাগে নি?"
> আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।
সুমীর তীক্ষ্ণ অথচ মৃদু গলাটা আরাফাত ভাইকে যেন চাবুকের মত আঘাত করল। উনি বুঝতে পারলেন উনি জীবনের সম্ভবত সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছেন। এই মেয়েতো বিয়েতে রাজি ছিল না। নিশ্চয়ই তার বাবা জোর করে তাকে বিয়ে দিয়েছে।
ইস! কাজটা একদম ভাল হয়নি। আমিতো একটা গাধা, আগেই কেন ভালভাবে খোজ নিলাম না!
প্রচণ্ড আফসোসে আরাফাত ভাই জায়গায় দাড়িয়েই নিজের অজান্তে মাথা নাড়তে লাগলেন।
বিপদে পড়লে আরাফাত ভাইয়ের মাথা খুব দ্রুত খেলে না। স্লো মোশনে খেলে। অন্যেরা যে বিপদ থেকে ফটাফট উঠে যায় সেখানে উনি উঠেন ঢিমেতালে। বাইরে থেকে কেউ দেখলে ভাববে উনার গরজ নেই। আসলে তা নয়। এই মুহূর্তেও আরাফাত ভাইয়ের মাথা ভিতরে ভাবনার ঝড় বইছে।
কেন আমাকে মেয়েটা পছন্দ করবে না? কেন বিয়েতে রাজি হয়নি?
আমার বয়স বেশি!
আর?
মেয়েটার হয়ত পড়াশোনার ইচ্ছা ছিল। বিয়ের ফলে সে ধরেই নিয়েছে তাকে আর পড়তে দেয়া হবে না।
আর?
মেয়েটার হয়ত বিভিন্ন শখ-আহ্লাদ ছিল, বিয়ে করার কারনে ধরেই নিয়েছে স্বামী এবং শ্বশুড়বাড়ির লোকজন সেগুলো পূরণ হতে দিবে না।
তাহলে এই মুহূর্তে আমি কি করতে পারি?
যেভাবেই হোক, মেয়েটাকে বোঝাতে হবে আমি তার পক্ষের লোক। আর আমি যেটা আশংকা করছি যদি সেগুলোই হয় তবে আমার বয়স বেশি-এই ব্যাপারটাতে তো আমার কিছু করার নেই। আমি কেন, কারোরই কিছু করার নেই। সো, এই পয়েন্ট বাদ। পড়াশোনা? ওকে, যতদূর করতে চায় আমি বাধা দিব না। আর শখ? কি শখ আমি কিভাবে জানব?
হয়ত বিড়াল পুষে, হয়ত ফুলের বাগানের শখ, হয়ত ঘুড়তে পছন্দ করে--আচ্ছা যাই হোক। পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বাইরে না গেলে আমি আপত্তি করব না। অবশ্য এই বয়সের একটা মেয়ের পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বাইরে তেমন কিছু থাকারও কথা নয়।
আচ্ছা, সে কি সারাদিন না খেয়ে ছিল? এই বয়সের মেয়েরা রাগ করলে তো খাওয়া-দাওয়া করার কথা না। আরেক ঝামেলা, কথাবার্তার যে ঝাজ! খাওয়ার কথা বললে আবার গ্লাস দিয়ে ঢিল দেবে নাতো?
দিলে দিক, আমার বউ, তার ভাল-মন্দ সব কিছুর দায়িত্ব এখন আমার। আমাকেই সামলাতে হবে।
আরাফাত ভাই বিছানার এক কোনায় বসলেন।
"দেখুন, আমি বুঝতে পেরেছি আপনি এই বিয়েতে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি।" -মৃদু গলায় শুরু করলেন আরাফাত ভাই। "আসলে আমি জানতাম যে, মেয়ে, মেয়ের পরিবার-এই বিয়েতে রাজি। আমাকে সম্ভবত ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। আমি কখনই মেয়ের অসন্তুষ্টির সাথে বিয়ে চাইনি। আমার বয়স বেশি। লেখাপড়াও তেমন একটা করিনি। তাই অনেক খোজাখুজির পরও আমার সমমানের পাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না। যখন শুনলাম মেয়ের ফ্যামিলি রাজি তখন অন্যকিছু খোজ নেবার প্রয়োজন মনে করিনি। এমনকি পাত্রীও দেখিনি। বিয়েতে মত দিয়েছি। কোন ভাবে যদি বুঝতে পারতাম এমন কিছু ঘটবে তবে হাজারবার ভাবতাম।"
"বিয়ে, সংসার নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি বিয়ের আগে।"-একটু দম নিয়ে আবারো শুরু করলেন আরাফাত ভাই। "আমি বিশ্বাস করি, মাঝি ও বৈঠার সমন্বয়ের মাধ্যমেই একটি নৌকা ভালভাবে চলতে পারে। মাঝি আছে বৈঠা নাই, নৌকা অচল। আবার বৈঠা আছে মাঝি নেই-তাতেই কোন লাভ নেই। কাজেই আপনার আমার সংসার যদি হয় তবে দু'জনের সম্মতিতেই হবে। বিয়ে যেহেতু হয়েই গিয়েছে সেহতু আমি ধরেই নিচ্ছি সংসার আমাদের করতে হবে। আমি নিজে পড়াশুনা বেশি করিনি। কিন্তু আমি চাই আপনি আপনার পড়াশুনা শেষ করুন। আমার বাড়ি থেকে একটু দূরেই সরকারী কলেজ আছে। আপনি চাইলে কালই সেখানে আপনাকে ভর্তি করে দেব........"
>আমার পানির পিপাসা পেয়েছে। --আরাফাত ভাইয়ের কথায় বাধা পড়েছে। আরাফাত ভাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে হচ্ছে প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে গিয়েছে।
আরাফাত ভাই নিজেই উঠে পাশের টেবিল থেকে পানি ও সেমাইয়ের বাটি হাতে নিয়ে আসলেন।
"নিন পানি নিন। সেমাইটাও একটু খেয়ে দেখুন।"
"জানেন, আমার বন্ধু-বান্ধব প্রতিবছর এদিক সেদিক বেড়াতে যায়। বিভিন্ন জায়গায় তারা গিয়েছে। বান্দরবান, রাঙামাটি, বক্সবাজার, সুন্দরবন, জাফলং... আমি একবারও তাদের সাথে যাই নি। সবসময় ভেবেছি যাব, তবে বিয়ের পর যাব। খুব মজা হবে তাই না?"
>চুপ করেন। আপনি বড় বেশি কথা বলেন।
ধমক খেয়ে আরাফাত ভাই চুপসে গেলেন। এই মেয়ে দেখা যায় কঠিন চীজ। তবে আরাফাত ভাই হতাশ হলেন না। তিনি খেয়াল করলেন, সুমীর গলায় আগের কাঠিন্য আর নেই। কার কাছ থেকে যেন শুনেছেন যেই মেয়ে যত কঠিন, সেই মেয়ের ভালবাসার ক্ষমতাও তত বেশি। কথাটা তিনি বিশ্বাসও করেন নি, অবিশ্বাসও করেন নি। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়।
আরাফাত ভাই লক্ষ্য করলেন ইতোমধ্যে সুমী সেমাই শেষ করেছে। তিনি আরেকটা বাটিতে কিছু ফল কাটা ছিল সেগুলোও নিয়ে আসলেন। দু'টুকরো আপেল হাতে নিয়ে নিজেই চিবুতে শুরু করলেন। ইচ্ছা করছিল একটুকরো সুমীকেও খাইয়ে দেন। কিন্তু অত সাহস আরাফাত ভাই করতে পারলেন না। সমস্যা নেই, বেঁচে থাকলে আরাফাত ভাইয়ের ইচ্ছা পূরণ হবে।
সুমী অবশ্য ফলের বাটির দিকে হাত বাড়ালো না। সেমাই আর পানি খেয়ে আবারো মূর্তি হয়ে গিয়েছে। আরাফাত ভাই দীর্ঘনিশ্বাস গোপন করে বললেন,
"আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি বারান্দার সোফায় ঘুমাবো।"
সুমী কিছুই বলল না।
সোফায় শুয়ে আরাফাত ভাই উদাস মনে আকাশের তারা গুনতে লাগলেন। ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন। ভাবছেন সুমীর মন তিনি জয় করতে পারবেন তো? তবে আরাফাত ভাই আশাবাদী। যাই ঘটুক তিনি নিরাশ হবেন না। যেটা হবে, সেটা ভালই হবে।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আরাফাত ভাইয়ের চোখ মুদে এল।
No comments:
Post a Comment