Featured Post

I SAID NO TO QUANTUM METHOD

পূর্বে পোস্ট আকারে প্রকাশিত। কারও সাথে ঝগড়া করার জন্য এটা দেইনি। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। কেউ মানতে না পারলে আমার কিছু করার নেই।  আ...

Saturday, July 11, 2015

ধৈর্য্য

মুসলিমদের অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের একটি বৈশিষ্ট্য হল ধৈর্য্যধারন করা এবং যেকোন অবস্থাতেই আল্লহর শুকরিয়া আদায় করা। তারপরও জীবন মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায় যখন আমরা অধৈর্য্য হয়ে পড়ি, শুকরিয়া করতে ভুলে যাই।

গতকাল ঢাকা থেকে আসলাম। আমার প্রায় সবকিছুই প্ল্যান করা থাকে। প্ল্যান ছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে কমলাপুর। কমলাপুর থেকে সুবর্ণ এক্সপ্রেসে আসব চিটাগাং। তারপর অফিসে বাসের রিটার্ণ ট্রিপে বাসায়। সব ঠিক থাকলে দুপুর সোয়া একটায় বের হয়ে রাত ১২ টার মধ্যে বাসায় থাকব। কিন্তু আমরা প্ল্যান করি এক, আল্লহর প্ল্যান থাকে আরেকরকম!

কমলাপুর আসলাম যথাসময়ে। ট্রেন ছাড়তে পনেরো মিনিট বাকি। বিজয় খুন, সালাউদ্দিন পাগল-টাইপ হট টপিক থেকে দূরত্ব কমাতে মিসেসকে অপেক্ষা করতে বলে কালের কন্ঠ আর ডেইলি স্টার কিনে নিলাম। ট্রেনে বসে আরামসে পড়া যাবে। আগের দু'দিন বৃষ্টিতে একটু গরম কম থাকলেও গতকাল বৃষ্টি হয় নি। ট্রেনে বসে বসে গরম ভালই টের পেলাম। মাথার উপরের ফ্যান অযথাই শোঁ শোঁ করে ঘুরছে।

সুবর্ন এক্সপ্রেস ট্রেন লেট করে না সাধারনত। গতকাল করল! নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৫০ মিনিট পর ট্রেন ছাড়ল। এয়ারপোর্ট থামবে, তারপর একটানে চিটাগাং। এয়ারপোর্টে ট্রেন দাড়াল। কিছুক্ষন পর মনে হল পানিতো শেষ হয়ে গেল, এক বোতল না হয় কিনেই নেই। নামব কি নামব না, ট্রেন কি ছেড়ে দেয় কিনা-এই আশংকায় আরো মূল্যবান কিছু সময় কেটে গেল।

নামলাম। নেমেই দৌড়। দোকানে গিয়ে একলিটার মাম চাইলাম। নেই। কি আছে? ফ্রেশ আছে। দেন বলেই পিছে তাকাতে দেখি ট্রেন ছুটতে শুরু করেছে। বুকের মধ্যে ধড়াস করে বাড়ি পড়ল। কত? ২৫ টাকা। হুর! মানিব্যাগ পকেট থেকে বের হয় না কেন? ট্রেনের গতি বাড়ছে।

গেভার্ডিং যখন পড়ি তখন আমার এই প্রবলেমটা হয়। মানিব্যাগ আটকে যায়। পানি না কিনেই ছুটে যাব। টানা টানির এক পর্যায়ে মানিব্যাগ মহাশয় পকেটের মায়া ত্যাগ করে আমার হাতে আসলেন। ২৫ টাকা বের করে দিয়ে বোতল নিয়েই দৌড় ততক্ষনে আমি যে বগি থেকে নেমেছি সেই বগি চলে গিয়েছে সামনে। মাথার ভিতরে তখন হাজার চিন্তা। আমি যদি ট্রেনে না উঠতে পারি তাহলে ট্রেনে যে আছে তার কি হবে? টিকেট আমার পকেটে! সাথে এতগুলো ভারী ব্যাগেজ। একা একা কখনো জার্নি করেনি.........

এইগুলো ভাবতে ভাবতেই ট্রেনের দরজার কাছে পৌছালাম। পরের বগির দরজার জন্য একটু দাড়ালাম। দৌড়িয়ে ট্রেনের দরজায় পৌছাবার মত নায়ক আমি নই। এরচেয় বগি আমার কাছে আসুক। একহাতে একলিটারের পানির বোতল। বোতল নিয়ে প্রথমবারের চেষ্টায় হ্যান্ডেল ঠিকমত ধরতে পারিনি। উঠতে পারলাম না ট্রেনে!

বোতল ছুড়ে দিলাম বোতল ভিতরে। তারপর একলাফে ট্রেনের ভিতরে। জীবনের প্রথমবার মত লাফিয়ে ট্রেনে উঠা। বুকের ভিতর হৃদপিন্ড তখন পাগলা ঘোড়ার মত লাফাচ্ছে!

উঠেই বগির এটেনডেন্টের জেরার মুখে। যাইহোক তাকে সন্তুষ্ট করে নিজের জায়গায় ফিরে আসলাম।

সুবর্ণ নাকি কোথাও থামে না। কিন্তু কাল টঙ্গী পার হয়ে এসেই আবার থামল। কি ঘটনা? কোন মহিলা নাকি ভুল করে এই ট্রেনে উঠে পড়েছে। তাদেরকে নামিয়ে দিল। এরপর যেন সুবর্ণ কোথাও থামে না- আমার এমন ধারনা ভুল প্রমাণ করতেই কিছুদূর পর পরই থামতে লাগল।

আমার মাথার ভিতর তখন টেনশন। সুবর্ন যদি লেট করে তবে অফিসের গাড়ি পাব না। সেক্ষেত্রে এই রাতের বেলা কিভাবে যাব। সিএনজি পাওয়া যাবে। কিন্তু একান্ত বাধ্য না হলে সিএনজিতে উঠতে চাই না।

পৌনে এগারোটার দিকে ট্রেন যখন একটু পরেই চিটাগাং স্টেশনে থামবে তখন আমার এক কলিগকে ফোন দিলাম। তার কাছে গাড়ির খবর নিব। গাড়ির খবর নিব কি, তিনি আমাকে যে খবর দিলেন তাতে আমার দু'ভ্রুর মাঝখানের কুঞ্চন দুশ্চিন্তায় আরো বাড়ল। কর্ণফুলি সেতুর কাছে নাকি মারামারি হয়েছে। গাড়ি চলাচল বন্ধ। অফিসের গাড়ি শহরে আসবে কিনা কনফার্ম না। তবুও উনার কথার উনার কাছ থেকে ড্রাইভারের নাম্বার নিলাম।

তবে ড্রাইভারকে ফোন না দিয়ে ফোন দিলাম আরেক কলিগকে। তিনি অফিস শেষ ঐ গাড়িতে করেই ফিরবেন। তাকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম যে, গাড়ি টাউনে আসবে না। তাদেরকে কলেজ বাজার নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফিরে গিয়েছে।

এখন কি করা? কি আর করা! বিকল্প পথে বোটে কর্ণফুলী পার হতে হবে। যেতে হবে পনের নম্বর ঘাট। এগারোটা বেজে গেছে। বেশি দেরি করলে বোট পেতে সমস্যা হতে পারে। সরাসরি যেতে হবে। সিএনজিই নিতে হল। এর মধ্যে বোঝা টেনে গরমে আমার অবস্থা কাহিল। সিএনজিতে উঠে ড্রাইভারকে বললাম, আইসক্রিমের দোকান দেখলে যেন থামায়। বিআরটিসি মোড়ের জ্যাম ঠেলে গাড়ী যখন ছুটতে শুরু করল তখন দেখলাম একের পর এক আইস্ক্রিমের বাক্স পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। পরেরটাতে হয়ত থামাবে ভাবতে ভাবতে যখন ভাবলাম আবার ড্রাইভারকে বলি থামাতে ততক্ষন এমন জায়গায় চলে এসেছি যেখানে দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তৃষ্ণা চেপে চুপচাপ বসে রইলাম।

পৌছাবার পর সিএনজিওয়ালা যখন আরো ২০ টাকা বেশি চাইল তখন দিলাম এক ঝাড়ি। টাকা দিয়ে ঘাটের দিকে পা বাড়াতেই পাশের থেকে একজন বলল, ঐ দিকে যাইয়েন না। ঘাট বন্ধ করে দিয়েছে। কেন? কি হয়েছে? র‍্যাবের কোন অফিসার আসবে।

মালপত্র সাইড করে দেখি রাস্তার অপর পাশে র‍্যাবের গাড়ির সারি। রাত তখন প্রায় বারোটা। এখানে বসার জায়গা নেই। র‍্যাবের তামাশা দেখি আর মনে মনে অভিসম্পাত করি। কোন দেশের কোন টুট টুট আসবে আর ঘাট বন্ধ করে আমাদের হয়রানি। সারাদিনের ক্লান্তির ধাক্কা বেশিক্ষন সইতে না পেরে আমার সহযাত্রী বন্ধ দোকানের সাটারের বেসের উপর বসেই পড়লেন। একটু পরে দেখি বস্তা মাথায় নিয়ে কয়েকজন আসল ঘাট থেকে। বস্তাগুল র‍্যাবের গাড়িতে তোলা হল। তখন সন্দেহ হল কোন চোড়াকারবারীকে মনে হয় আটকানো হয়েছে।

প্রায় আধাঘন্টা পরে আমরা ঘাটের দিকে গেলাম। ওখানে তখন র‍্যাবের কর্মকর্তা লেখালেখি করছে। আমাদের দেখে বসতে বললেন। বোট নাকি নেই। ওপার থেকে আসলে আমরা যেতে পারব। কিন্তু স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম বোট এখানেই আছে। এরইমধ্যে র‍্যাবের একজনের মুখে "পাচ লাখ" কথা শুনেই স্বগোক্তির মত করলাম, পাঁচ লাখ কি? শুনেই আমার সহযাত্রী আমাকে চুপ থাকতে ইশারা করেন, আমি এত বেশি কথা কেন বলি? উনার খোচাখুচি দেখে র‍্যাবের একজন ভয়ংকর দর্শন, মাথায় কালো কাপড় প্যাচানো, কালো গোঁফওয়ালা, বন্ধুকধারী (সম্ভবত) হাবিলদার মুচকি হেসে ফেললেন। আমি পুরো অবাক হয়ে গেলাম। মূহূর্তেই ঐ ভয়ংকর দর্শনধারী লোকটাকে আমার নিরীহ, ভালমানুষ বলে মনে হতে লাগল যার বউ হয়ত তার অপেক্ষায় আছে। সে গেলেই তার ছোট মেয়েটা দৌড়ে ছুটে আসবে। আর তিনি দু'হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নিবেন।

পার হতে হতে প্রায় রাত পৌনে একটা। পার হবার সময় ভাবছিলাম হয়ত ৫লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছে র‍্যাব। পার হবার পর সবাই হুড়োহুড়ি করে বোট থেকে নেমে গেল। যদি সিএনজি না পাওয়া যায়! আমরা নেমে যখন সিএনজি স্ট্যান্ডে আসলাম ততক্ষনে সবধনে নীলমনি যে সিএনজিটা ছিল সেটা ভরে গিয়েছে। যারা স্থান পায়নি তারা হাটা শুরু করেছে। রাগে-দূঃখে, হতাশায় বস্তা মাথায় নিয়ে হাটা দিলাম। কিন্তু দোকানদারের কথায় মাথা ঠান্ডা হল। এমনিতেই রাত, সাথে মহিলা, তার উপর এতগুলো ভারী ব্যাগ। একা হলে একটা কথা ছিল। যা থাকে কপালে ভেবে হাটা দিতাম। আমি হয়ত হেটেই যেতে পারতাম শরীরের সব ঘামের বিনিময়ে কিন্তু সহযাত্রীর কথা ভেবে এই নিশুতি রাতে দোকানদারের কথায় একমত হলাম। বসলাম তার দোকানে। সাদা পানি, কোমল পানি-সবই খেলাম। এখন শুধু অপেক্ষা, যে সি এন জিটা গিয়েছে সেটা আবার কখন ফিরে আসে!

নিজের জন্য চিন্তা নেই। অথচ যার জন্য চিন্তিত ছিলাম তার মুখে কোন দুশ্চিন্তার লেশমাত্র নেই। নেই কোন অভিযোগ!

প্রায় পনের বিশ মিনিট পর সি এন জি টা ফেরত এল। কিন্তু আমাদের থেকে প্রায় একশ গজ সামনে থেকে যাত্রী উঠিয়ে ইউটার্ণ নিয়ে চলে গেল। সেই সিএনজির মালিক আমাদের সাথেই ছিল। লোকটা পিছন থেকে অনেকক্ষন ডাকল। কিন্তু ড্রাইভারের কানে সে ডাক হয়ত পৌছেই নাই।

এরই নদী পার হয়ে আরো লোক উপস্থিত। টেনশন আরো বাড়ল। সি এন জি আবার আসলেও উঠতে পারব কিনা। এত লোক! প্রায় পনেরমিনিট অপেক্ষা করার পর কিছু লোক হাটা শুরু করল। আর এদিকে সি এন জির মালিক একে তাকে ফোন করে ঐ ড্রাইভারের নাম্বার নিয়ে ফোন করতে শুরু করলেন।

মনেহয় রাত তখন দেড়টা। সিএনজিটা আবার আসল। গাড়ি থামতেই ঐ লোক এসে ড্রাইভারকে চড়-থাপ্পড়। তখন কেন সে গাড়ি ঘুড়িয়েছিল?

তবে যারা বাকি ছিল তারা বেশ ধৈর্য্যের পরিচয় দিল। সবার সামনে দিয়ে আমরা আগে উঠলাম। মালপত্র সাইড করলাম। তারপর অন্যরা উঠল। আমরা মানুষ দু'জন। কিন্তু আমাদেরই ব্যাগ ৩ টা। অন্যদের কথা বাদই দিলাম। শুধু একজনের কথা বলি। তার কাছে ছিল দুই বস্তা শুটকি।

পিছনে ৪ জন, সামনে ৪ জন, একপাশে হেল্পারের মত দাঁড়িয়ে একজন, মোট নয় জন নিয়ে সি এন জি তার যাত্রা শুরু করল। ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত ওজন থাকায় গোঁ গোঁ করতে করতে একসময় সি এন জি তার পরবর্তী স্ট্যান্ডে পৌছাল।

এখন? আমাদের কি হবে? এখান থেকে আমাদের গন্তব্য আরো ১০ মিনিটের হাটা রাস্তা। এই রাস্তায় প্রায়ই গভীর রাতে ছিনতাই-ডাকাতী হয়। এখানে পুলিশের একটা টহল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাছে হেল্প চাইব কিনা ভাবছিলাম। এরই মধ্যে বাজারে একজন পাহাড়াদার আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। আমাদের দুরববস্থার কথা শুনে তিনিই আমাদের প্রস্তাব দিলেন যে, আমাদের এগিয়ে দিবেন। আমি বিশেষ ভরষা না পেলেও অনন্যোপায় হয়ে তার পিছু নিলাম। আর আমার পিছনে আমার সহযাত্রী!

ব্যাগের মধ্যে আমার শ্বাশুড়িআম্মা লোহা ভরে দিয়েছেন কিনা ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে পৌছে গেলাম। ঐ পাহাড়াদার কবির ভাইকে আমি কিছু বিনিময় দিতে চাইলে উনি সবিনয় তা প্রত্যাখ্যান করলেন। আল্লহ তাকে উত্তম প্রতিদান দিক।

তালা খুলে যখন ঘরে ঢুকলাম তখন ঘড়ির কাটা দু'টোর ঘরে অবস্থান করছে। রান্না-বান্না করে খেয়ে শুতে শুতে প্রায় চারটা বেজে গেলাম। শুয়ে শুয়ে একটু ভাবার চেষ্টা করলাম, আজকের ঘটনা প্রবাহ এরচেয়েও খারাপ হতে পারত কিনা।

ট্রেনের বগি লাইনচ্যূত হতে পারত। পারত সিএনজি হাইজ্যাক হতে। র‍্যাবের অভিযান শেষ হতে সারারাত লাগতে পারত! সিএনজির মালিক যদি আমাদের ওখানে না থাকত! কি হত যদি ঐ পাহাড়াদার কবির ভাই আমাদের সাহায্য না করতেন?

আল্লহর শুকরিয়া তিনি আমাদের অতটা কঠিন পরীক্ষায় ফেলেননি। আলহামদুলিল্লাহ!

[ফুটনোটঃ আজকের ব্রেকিং নিউজে দেখেছেন হয়ত "চট্টগ্রামে বহির্নোঙ্গর থেকে ৫ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার। ৭ জন আটক।" ]

No comments: