প্রতিবার ভূমিকম্পের পর ফেসবুকে প্রধানত দু'ধরনের স্ট্যাটাস দেখতে পাই। একদল বলতে থাকে, জেনা-ব্যাভিচার, নারী উলঙ্গপনা, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদির কারনে আল্লাহর আযাব এসেছে। আরেকদল ভূমিকম্পের ব্যাখ্যায় ভূগোলের সাহায্য নেন এবং প্রথোমক্ত ব্যক্তিদের মোটামুটি তুলোধুনো করে নানান বিশেষণে সম্মানিত করে থাকেন!
আল্লাহ তায়ালা বলেন, "স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ্ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদরন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।" (সূরা আর-রুম, আয়াত ৪১,৪২)
এই আয়াতের তফসীরে বলা হয়েছে, "অর্থাৎ স্থলে, জলে তথা সারা বিশ্বে মানুষের কুকর্মের কারণে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। তফসীরে রুহুল মা'আনীতে বলা হয়েছে, 'বিপর্যয়' বলতে দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অগ্নিকান্ড, পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনাবলীর প্রাচুর্য, সবকিছু থেকে বরকত উঠে যাওয়া, উপকারী বস্তুর উপকার কম এবং ক্ষতি বেশি হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিপদ আপদ বোঝানো হয়েছে।"
অন্যত্র আছে, "হ্যা, ব্যাপকাকারের বিপদাপদ-যেমন দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মহামারী ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বরকত নষ্ট হএয় যাওয়া ইত্যাদির প্রধান কারন মানুষের প্রকাশ্য গোনাহ্ ও পাপাচার হয়ে থাকে।"
আরো বলা হয়েছে, "তাই কোন কোন আলিম বলে, যে ব্যক্তি কোন গোনাহ্ করে সে সারাবিশ্বের মানুষ, চতুষ্পদ জন্তু ও পশুপক্ষীদের প্রতি অবিচার করে। কেননা, তার গোনাহের কারণে অনাবৃষ্টি ও অন্য যেসব বিপদাপদ দুনিয়াতে আসে, তাতে সব প্রাণীই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই কেয়ামতের দিন এরা সবাই গোনাহ্গার ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে।
শকীহ যাহেদ বলেন, যে ব্যক্তি হামার মাল খায়, সে কেবল যার কাছ থেকে এই মাল নেওয়া হয়েছে, তার প্রতিই জুলুম করে না; বরং সমগ্র মানবজাতির প্রতিই অবিচার করে থাকে। --(রুহুল মা'আনী) কারণ, প্রথমত একজনের জুলুম দেখে অন্যদের মধ্যেও জুলুম করার অভ্যাস গড়ে উঠে এবং এটা সমগ্র মানবতাকে গ্রাস করে নেয়। দ্বিতীয়ত তার জুলুমের কারনের দুনিয়াতে বিপদাপদ আসে, যদ্বারা সব মানুষই কমবেশি প্রভাবান্বিত হয়।"
(তফসীরে মা'আরেফুল কোরআন, ৬ষ্ঠ খন্ড)
কুরআনুল কারীমের বর্ণনা থাকে স্পষ্ট বোঝা গেল, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূল কারন মানুষের প্রকাশ অবাধ পাপাচার। এই সহজ ব্যাপারটা জেনে হোক, না জেনে হোক, বুঝে হোক না বা না বুঝেই হোক মুসলিম ঘরের অনেক সন্তানই মেনে নিতে পারে না সম্ভবত দুইটি কারনেঃ
১. পাপকে পাপ মনে না করাঃ সুদের সাথে সংশ্লিষ্টতা হারাম। অথচ আমরা সুদকে হারাম মানতে পারছি না। একইভাবে নারী পুরুষের অবাধ অবৈধ মেলামেশা, গানবাজনা আয়োজন, ফটোগ্রাফি, অমুসলিম সংস্কৃতি ধারন ও পালন, মদ খাওয়া, জুয়া খেলা, লটারি ইত্যাদি সমাজে এত ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে যে এখন আর এগুলোকে হারাম মনে হচ্ছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে একসময় যাবতীয় হারাম কাজ হালাল হয়ে যাবে।
২. ভুমিকম্পকে বিপর্যয় মনে না করাঃ জ্ঞান হবার পর যতগুলো ভূমিকম্প হয়েছে সবগুলোতে শুধুই কম্পণ ছিল। নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, ইকুয়েডরে ভুমিকম্প ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় অনেক ক্ষতিসাধণ হবার পরেও এদেশে তেমন কিছু হয় নি। অর্থাৎ ভুমিকম্পের চাক্ষুস অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কাজেই ভুমিকম্পকে আমাদের ভুমিকম্প মনে হয় না। বরং অনেকটা ঈদ-ঈদ মনে হয়। তাই সাজুগুজু করে ছবি তুলে সেলফি ফেসবুকে আপ্লোড দেই। ঘুর্ণিঝড় আমাদের কাছে বিপর্যয় কারন ১৯৯১ এর স্মৃতি আমাদের আছে, বন্যা আমাদের কাছে বিপর্যয় কারন ১৯৮৮, ১৯৯৮ এর স্মৃতি আমাদের আছে, দুর্ভিক্ষ আমাদের কাছে বিপর্যয় কারন ১৯৭৪ এর কথা আমরা বইতে পড়েছি। হায় আফসোস, ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের এমন কোন স্মৃতি নেই।
মনের ভিতর খচখচ করছিল তাই লিখলাম। যার ইচ্ছা হয় মেনে নিবেন, যার ইচ্ছা হয় বিশেষণে সম্মানিত করবেন।
ফী আমানিল্লাহ!
No comments:
Post a Comment