চোরের দেশে চুরি না করার উপায় কি?
কথা আসলে বলতে চাচ্ছিলাম আয়কর নিয়ে। যারা এখনো আয়করের পাল্লায় পড়েন নি তারা পড়ে দেখতে পারেন। আর যারা আয়করের গ্যাড়াকলে পড়ে গিয়েছেন তারা আমার সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন।
প্রায় আটবছর আগে চাকুরীতে যোগদানের বছরখানেকের মধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই আয়করের খাতায় নাম উঠে যায়। যে তৃতীয় পক্ষ আমাদের কাগজপত্র নাড়াচাড়া করত তার নাম ছিল সম্ভবত মাওলা ব্রাদার্স। আয়করের কিছুই বুঝতাম না বিধায় ওরা যা বলত তাই করতাম, যেখানে সই করতে বলত করে দিতাম। আমাদের কোম্পানি আবার আমাদের কে বাধ্যতামূলক ঋণ দেয় যেন ঋনের টাকা বিনিয়োগ করে আয়কর রিবেট পাওয়া যায়। এই রিবেটের সুবিধা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি নি। কোম্পানিতো আয়কর দিয়েই দিচ্ছে তাহলে ঋন দেয়ার সুবিধাটা কি?
সে যাই হোক। একবছর সই করে দিতাম, পরের বছর আবার দিতাম। তথ্য লেখালেখির কাজ সব মাওলা ব্রাদার্সের লোকেরাই করত। কয়েকবছর এভাবে চলার পর একদিন দেখলাম আমার মোট সম্পত্তি ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে! নগদ টাকা কাগজে কলমে প্রায় ২০ লাখ! অথচ শেয়ার বাজারে কিছু বিনিয়োগ ছাড়া আর কোন টাকাই নেই। তাও কোম্পানি যা ঋণ দেয় তাই শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করি। এভাবে কিছু টাকা জমেছে। আর বাকি যা বেতন বোনাস পাই তা দিয়ে সংসার চলে যায়।
কাজেই গতবছর যখন মাওলা ব্রাদার্সের লোকজন আসল তখন তাদেরকে বললাম আমারতো এত সম্পদও নেই, হাতে নগদ টাকাও নেই। কিন্তু কাগজে কলমে আমি প্রায় অর্ধকোটি টাকার মালিক হয়ে গিয়েছি। এটা অবশ্যই কমাতে হবে। উনারা পরামর্শ দিলেন তাহলে মোট খরচ বাড়াতে হবে। ঠিক আছে আনুমানিক খরচসমূহ বাড়িয়ে দিলাম।
চলতি অর্থবছরে মাওলা ব্রাদার্সের সাথে কোম্পানি চুক্তি বাতিল করে হুদা ভাসানী কোম্পানির সাথে নতুন চুক্তি করে। মাওলার অভিযোগ আমাদের কোম্পানিত ঠিকমত তাদের প্রাপ্য দিচ্ছে না। আর কোম্পানি বলছে চুক্তিতে যা আছে তাই দেয়া হবে। এই দ্বন্দে হুদা ভাসানীর সাথে চুক্তি হল নতুন করে।
হুদা ভাসানী যখন আমাদের পুরাতন কাগজপত্রের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে গেল তখন নতুন কিছু তথ্য জানা গেল যে, মাওলা ব্রাদার্স গত ১৪-১৫ অর্থ বছরের কাগজগুলো জমা দেয় নি। আর ১৩-১৪ অর্থ বছরের যে কাগজ জমা দিয়েছে তাতে সংযুক্তি হিসেবে কোন কাগজই দেয়নি! শুধু রিটার্ন ফর্ম জমা দিয়েছে।
১৪-১৫ কাগজ ঘাটতে গিয়ে দেখি আরেক ঘাপলা। এর আগের বছরের মোট সম্পত্তি যা ছিল সেটা তারা তুলে নি। আমি বলেছি নগদ টাকা কমাতে আর তারা পুরো সম্পত্তি গায়েব করে দিয়েছে। পুরো ৩৫ লাখ টাকার ঘাপলা!
১৪-১৫ এবং ১৫-১৬র কাগজপত্র ঘাটতে যেয়ে আমার এই ঘাপলা চোখে পড়ে। হুদা ভাসানীর যে প্রতিনিধি সাথে আমার কথোপকথন হয়েছে তিনি এই ঘাপলা ধূর করার পর মোট সম্পত্তি আরো প্রায় ৮ লাখ টাকা বেড়ে গেল। গত বছরের তুলনায় এই বছর সম্পত্তি বেড়েছে প্রায় তিন লাখ! ক্যাশ ইন হ্যান্ডও বেড়েছে! অথচ আমি মানিব্যাগে ২ টা ৫০০ টাকা নিয়ে ঘুড়ে বেড়াই। কিছু খেতে মন চাইলেও কিনি না। কাপড়চোপড় কেনা দরকার সেটাও কিনছি না। মাসের মাত্র ১৬ তারিখ। বাকি মাসটা চলতে হবে তো...
এত টাকার সম্পত্তি নিয়ে বড়লোক হয়েছি এখন ছোটলোক হতে হবে না? ছোটলোক হবার জন্য করনীয় কি? করণীয় একটাই গত অর্থবছরের খচর বাড়তি দেখাতে হবে। এর আগেই একটা আনুমানিক খরচ দিয়েছিলাম যে, কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে। এই খরচে কুলাচ্ছে না। বরং সম্পত্তি আরো বেড়ে গিয়েছে। আয়ের সমান ব্যয় হচ্ছে না। অথচ হাতে কোন টাকা নেই। তাহলে টাকা গেল কোথায়? আল্লাহই ভাল জানেন!
কাজেই আগে যে খরচ দেখিয়েছিলাম সম্পত্তি কমানোর জন্য এখন খরচ প্রায় দ্বিগুন করে দিলাম। এখন আয়ের চেয়ে ব্যয় বাড়ল। মোট সম্পত্তি ও নগদ টাকার পরিমান কমে গেল। মনের ভিতরে খচখচ করছে।
unsure emoticon
আয়কর রিবেটের ক্ষেত্রে এই নিয়ম আমার জানা ছিল না যে, যেখান টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে সেখানে বিনিয়োগের পরিমান যদি তুলে ফেলা টাকার পরিমানের চেয়ে কম হয় তবে আর বিনিয়োগকৃত টাকা রিবেটের জন্য প্রযোজ্য হয় না। অর্থাৎ কোম্পানি যদি আমাকে ১ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে থাকে বিনিয়োগ করার জন্য এবং আমি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করি তাহলে ঐ অর্থবছরে যদি আমি ২ লাখ টাকা শেয়ার বাজার থেকে তুলে ফেলি তাহলে বিনিয়োগ কৃত ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ বলে গন্য হবে না।
কাজেই ঐ এক লাখ টাকার জন্য যে ট্যাক্স কোম্পানি দিয়ে দেবার কথা ছিল সেটা আর তারা দিবে না। আমাকে দিতে হবে। এই ফাঁপড়ে পড়ে দেখি আমার আয়কর দিতে হবে প্রায় ১২ হাজার টাকা। পকেটে দুই হাজার টাকাই নেই আর আমি দিব ১২ হাজার টাকা!
এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? উপায় নেই। তবে জুয়া খেলার উপায় আছে। উনারাই বলে দিলেন আপনার বিনিয়োগ আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু কোন কারনে এটা যদি রাজস্ব বোর্ডের কেউ খতিয়ে দেখে তাহলে কিন্তু পরবর্তীতে আপনাকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে দিতে হবে। আর যদি না পড়ে তাহলে তো হলই।
এটাও চুরি। কিন্তু সম্মত না হয়ে উপায় কি? উনারা বুদ্ধি দিলেন পরে যদি এমন করেন তাহলে যে উৎস থেকে টাকা তুলে ফেলবেন সে উৎসে ঐ অর্থবছরে বিনিয়োগ করবেন না। তাহলে আর এই ঝামেলা হবে না। যেমন ধরেন, আপনি যদি সরকারী যাকাত ফান্ডে টাকা দিতেন তাহলে কিন্তু বিনিয়োগ হিসেবে গন্য হত!
সরকারী যাকাত ফান্ড! ঐখানে দিব টাকা! ঐ ফান্ডের টাকা কোথায় কিভাবে খরচ হয় আল্লাহই ভাল জানেন। সরকারের সুনজরে পড়ে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিল করার ইচ্ছাও নেই যে সরকারী যাকাত ফান্ডে টাকা দিব।
সিস্টেমের ত্রুটিও একটা বড় ব্যাপার। ই-টিন রেজিস্টারের জন্য রাজস্ব বোর্ডের ওয়েব সাইটে প্রথমবার যখন ঢুকতে চেয়েছিলাম তখন ঢুকতে পারিনি। কারন কি? কারন রাজস্ব বোর্ডের সার্ভার সিকিউর প্রটোকল (HTTPS) সাপোর্ট করে না। এবং এর তত্তাবধানের ব্যবস্থা এতই দুর্বল যে আমাদের মধ্যে অনেকেই ই-টিন অনলাইনে করতে পারেন নি। কারনে তার পূর্বের টিন নাম্বার ইতোমধ্যেই কেউ রেজিস্ট্রেশন করে ফেলেছে। রাজস্ব বোর্ড থেকে যদি টিন নম্বর ফাঁস না হয়ে থাকে তাহলে কিভাবে কারো অজান্তে তার টিন নাম্বার দিয়ে ই-টিন রেজিস্ট্রেশন হল? আল্লাহই ভাল জানেন।
সিস্টেমের ত্রুটির কারনে কার মনোভাব কি বোঝার উপায় নেই। এতে করে ফাঁকিবাজদের খুব সুবিধা হয়েছে। তারা বড় বড় ফাঁকি মারতে পারছে। আর যারা আসলেই আয়কর দিতে চায় তাদের পড়তে হয় বিরাট গ্যাড়াকলে।
গ্যাড়াকল থেকে মুক্ত থেকে চুরি না করার উপায় কি?
No comments:
Post a Comment