নাজনীন আক্তার হ্যাপি। এদেশের অনলাইন জগতে অতি আলোচিত সমালোচিত একটি নাম। কিভাবে তার উথান সে ব্যাপারে আশা করি মোটামুটি সবাই অবগত। পূর্বজীবনে তার কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে আমরা অনেকেই তার সমন্ধে বাজে কথা বলেছি, বাজে ভাবে কথা বলেছি, হুলস্থুল ট্রল করেছি। হ্যাপির জীবন এখন পুরো উলটো।
সত্য-মিথ্যা জানি না, যতদূর শুনেছি, তাবলীগের দাওয়াতের দ্বারা হ্যাপীর জীবন ঘুরে গিয়েছে। দাওয়াত প্রাপ্তির পর প্রথমে মহিলাদের বয়ান শুনেছেন, তারপর সময় লাগিয়েছেন। এরপর থেকে পরিপূর্ণ, আপাদমস্তক পর্দা করা শুরু করেছেন। এখন মাদ্রাসায়ও ভর্তি হয়েছেন। মাদ্রাসায় ২৮ দিন কাটানোর পর ছুটিতে এসে ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তাতে বোঝা যায়, তিনি সত্যিই মাদ্রাসায় পা রেখেছেন। তার অন্তরের অবস্থা আল্লাহই ভাল জানেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি আশা করব যেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে দ্বীনের খেদমতগার হিসেবে কবুল করেন। তার মর্যাদাকে বর্ধিত করেন!
ছাহাবী মায়েজ (রাঃ) যেনা করিয়াছিলেন, তাহার কোন সাক্ষী ছিল না, কিন্তু এই পাপের ভয় তাঁহার অন্তরে এক অসহনীয় অগ্নিরূপ ধারণ করিয়াছিল। তিনি আবু বকর রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর নিকট আসিয়া বলিলেন, এই হতভাগা যেনা করিয়াছে। আবু বকর (রাঃ) বলিলেন, আমি ব্যতীত অন্য কাহারও নিকট তুমি ইহা প্রকাশ করিয়াছ কি? মায়েজ (রাঃ) বলিলেন, না। আবু বকর (রাঃ) বলেন, তবে তুমি আল্লাহ তাআলার নিকট তওবা কর এবং আল্লাহ তাআলা তাহা গোপন থাকার যে সুযোগ তোমাকে দান করিয়াছেন তুমি সেই সুযোগ গ্রহণ করিয়া গোপনই রাখ; নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা বান্দার তওবা কবুল করিয়া থাকেন।
এই কথায় মায়েজের অন্তরে শান্তি আসিল না। তিনি ওমর রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর নিকট আসিলেন। তিনিও তাঁহাকে ঐরূপই বলিলেন, যেরূপ আবু বকর (রাঃ) বলিয়াছিলেন। এই বারও মায়েজের অন্তরে শান্তি আসিল না। অবশেষে তিনি পাগলপারা হইয়া তাঁহার গৃহস্বামীর পরামর্শে স্বয়ং হযরত রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হইলেন এবং বলিলেন, এই হতভাগা যেনা করিয়াছে। হে আল্লাহর রসূল! আমাকে পাক পবিত্র করুন। ইয়া রসূলাল্লাহ আমি যেনা করিয়াছি; আমার উপর আল্লাহর কুরআনের হুকুম জারি করুন। ইয়া রসূলুল্লাহ! আমি আমার সর্বনাশ করিয়াছি--আমি যেনা করিয়াছি---আমার আকাংক্ষা আপনি আমাকে পাক-পবিত্র করিবেন। এমনকি রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের হাতে হাত রাখিয়া বলিলেন, পাথর মারিয়া আমাকে প্রাণে বধ করিয়া ফেলুন। হযরত (সঃ) তাঁহাকে বলিলেন, "ধিক্ তোমার প্রতি--চলিয়া যাও এবং আল্লাহর নিকট তওবা-এস্তেগফার কর। এই বলিয়া হযরত (সঃ) তাঁহার দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া নিলেন এবং তাঁহাকে তাড়াইয়া দিলেন। কিন্তু মায়েজ (রাঃ) তৃতীয়বার আবার হযরতের দরবারে আসিয়া ঐরূপ বলিলেন। এই বারও হযরত (সঃ) তাঁহাকে হাঁকাইয়া দিলেন। এমনকি কেহ তাঁহাকে এই বারও সতর্ক করিয়া দিল যে, তুমি চতুর্থবার স্বীকারোক্তি করিলে তোমাকে প্রস্তরাঘাতে প্রাণে বধ করিবেন। কিন্তু কোন ভয়-ভীতি মায়েজ (রাঃ)-কে নিবৃত্ত ও ক্ষান্ত করিতে পারিল না, তিনি চতুর্থ দিন আবার হযরতের দরবারে আসিয়া ঐরূপই বলিলেন।
এইবার হযরত (সঃ) তাঁহার দিকে লক্ষ্য দিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, কি ব্যাপারে তোমাকে পাক করিব? মায়েজ (রাঃ) স্পষ্ট ভাষায় বলিলেন, যেনার পাপ হইতে আমাকে পাক করিবেন। হযরত (সঃ) তাঁহাকে এই কথাও জিজ্ঞগাস করিলেন, তুমি কি উন্মাদ? তিনি বলিলেন, না। হযরত (সঃ) যাচাই করিলেন, তিনি কোন নেশা পান করিয়াছেন কিনা, এমনকি এক ব্যক্তি দাড়াইয়া তাহার মুখ শুঁখিয়া দেখিল, তাহাতে কোন নেশা বস্তুর দুর্গন্ধ পাওয়া গেল না। হযরত (সঃ) তাঁহার বাড়ীর লোকদের নিকট যাচাই করিলেন, তিনি উন্মাদ কিনা। সকলেই সাক্ষ্য দিলে সে সম্পূর্ণ সুস্থ। হযরত (সঃ) ইহাও জ্ঞাত হইলেন যে, তিনি বিবাহিত। অতঃপর হযরত (সঃ) তাঁহার প্রতি "রজম-প্রকাশ্যে প্রস্তরাঘাতে প্রাণে বধ করার আদেশ প্রদান করিলেন।"
সেমতে তাঁহাকে ঈদগাহের খোলা ময়দানে নিয়া যাওয়া হইল এবং তাঁহার উপর প্রস্তর নিক্ষেপ আরম্ভ করা হইল। সর্বপ্রথম আবু বকর (রাঃ) প্রস্তর নিক্ষেপ করিলেন। সংগে সঙ্গে চতুর্দিক হইতে প্রস্তর বর্ষিত হইতে লাগিল। প্রস্তর আঘাতে মায়েজ (রাঃ) স্বাভাবিকরূপে ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন বটে, কিন্তু তিনি তাঁহার স্বীকৃতি প্রত্যাহার করার কোন উক্তি মুখে উচ্চারণ করেন নাই। অথচ তিনি তাঁহার স্বীকৃতি প্রত্যাহার করিলে শরীয়তের বিধানমতে তাঁহার প্রাণ-বধ কার্য স্থগিত হওয়া স্থিরকৃত ছিল এবং প্রস্তর বর্ষণে বিরত থাকিতে সকলেই বাধ্য হইত। মায়েজ (রাঃ) স্বীয় জানের প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করেন নাই। তাঁহার একমাত্র লক্ষ্য ছিল যেনার পাপ হইতে পবিত্রতা লাভ করা। সেই লক্ষ্য অর্জনে তিনি প্রাণ বিসর্জনে কুণ্ঠা বোধ করিলেন না। ছুটাছুটির মধ্যেই একটি পাথর তাঁহার কর্ণমূলে আঘাত করিলে তিনি মাটিতে পড়িয়া গেলেন এবং নিকটবর্তী একটি বৃক্ষের গোড়ায় ডান কাতে স্বীয় বাহুর উপর শুইয়া পড়িলেন। চতুর্দিক হইতে প্রস্তর বর্ষিত হইতে ছিল। হঠাৎ একটি উটের মাথার বিরাটকায় হাড় তাঁহাকে ভীষণভাবে আঘাত করিল, তাহাতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন "রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ও আরজাহু-- হে আল্লাহ! তুমি তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট হও এবং তাহার মনোবাসনা পূর্ণ করিয়া তাঁহাকে সন্তুষ্ট কর"।
মায়েজ রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর আত্মবিসর্জনের পর তাঁহার সম্পর্কে লোকদের মুখে উভয় রকম মন্তব্যই আলোচিত হইল। একদল বলিল, মহাপাপা পাপী হইয়া মারা গিয়াছেন। অপরদল বলিল, মায়াজের তওবা অপেক্ষা উত্তম তওবা আর হইতে পারে না। ঘটনার তিনদিন পর রসূলুল্লাহ (সঃ) সকলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন--
"তোমরা সকলে মায়েজের জন্য ক্ষমার দোয়া কর; সে এমন তওবা করিয়াছে যে, তাহার তওবা সমাজের সকল লোকের উপর বণ্টন করিয়া দিলে সকলের গোনাহ মাফের জন্য তাহা যথেষ্ঠ হইবে।" হযরতের আদেশ মতে ছাহাবীগন সমবেতভাবে তাঁহার জন্য মাগফেরাতের দোয়া করিলেন।
হযরত (সঃ) তাঁহার সম্পর্কে আরও বলিলেন -- "তাহার সমস্ত গোনাহ মাফ করিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং তাহাকে বেহেশতে প্রবেশ করাইয়া দেওয়া হইয়াছে।"
"আমি তাহাকে বেহেশতের নহরসমূহে আনন্দে আবগাহন করিতে দেখিয়াছি।"
"তাহাকে মন্দ বলিও না; সে আল্লাহ তাআলার নিকট মেশক বা কস্তুরীর সুগন্ধি অপেক্ষা অধিক প্রিয়।"
"আমি তাহাকে বেহেশ্তের নহরে আনন্দে ডুবাইতে দেখিয়াছি।"
[আলোচ্য ঘটনাটি সহীহ বুখারীর সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৩, ৮৪, ৮৫ তে উল্লেখ আছে।]
মায়েরজ (রাঃ) ঘটনার পরেই গামেদ গোত্রীয় এক নারীর অনুরূপ ঘটনা সহীহ বুখারীতে এসেছে। তাকেও প্রস্তরাঘাতে হত্যা করার সময় ছাহাবী খালেদ (রাঃ) গায়ে রক্তের ছিটা পড়িল এবং তিনি তাকে মন্দ বলে উঠলেন। হযরত (সঃ) খালেদের মন্দ বলা শুনতে পেয়ে বললেন, "মুখ সংযত রাখ। যাঁর হাতে আমার জান তাঁর কসম -- মহিলাটি এমন তওবা করেছে যে, যেকোন মহাপাপী ঐরূপ তওবা করলে তার মাগফেরাত হয়ে যাবে।
মহিলাটির লাশ নিয়ে আসা হইল এবং হযরত (সঃ) তাঁহার জানাযার নামায পড়াইলেন। ওমর (রাঃ) বলিলেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি তাহার জানাযার নামায পড়িলেন, অথচ সে যেনা করিয়াছিল। তদুত্তরে হযরত (সঃ) বলিলেন,
"মহিলাটি যে তওবা করিয়াছে তাহা যদি মদীনাবাসীদের উপর বণ্টন করিয়া দেওয়া হয়, তাহাদের পাপীর সংখ্যা সত্তর হইলেও সকলের পাপ মোচনে তাহা যথেষ্ঠ হইবে। এর চেয়ে অধিক তওবা আর কি হইতে পারে যে, সে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার মানসে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়াছে।
আল্লাহু আকবার!
হ্যাপীও নিশ্চয়ই তওবা করেছে। তার নিজস্ব মিডিয়ার জগত ছেড়ে দ্বীনের পথে পা বাড়িয়েছে। পরিবার পরিজন ছেড়ে মাদ্রাসায় পড়ছে। অথচ হ্যাপীর মত অসংখ্য মেয়ে হ্যাপীর পূর্বজীবনের পথেই আছে!
হ্যাপী ফিরে এসেছে। আমরা কবে ফিরব? আমি কবে ফিরব? এতদিন হ্যাপীকে নিয়ে যে ট্রল করেছি, রসিয়ে রসিয়ে কথা বলেছি তার জন্য কি অনুতপ্ত হয়েছি? তওবা করেছি?
বস্তুত তওবার সৌভাগ্য সবার হয় না। তার আগেই মৃত্যুর ডাক চলে আসে।