ঘটনা-১
প্রায় দুই-যুগ আগের কথা। দুর্গা পূজার মৌসুম। এদেশের অনেক জায়গার মত খুলনার এক স্কুলের দশম শ্রেণির কিছু ছাত্র পরিকল্পনা করেছে পূজা দেখতে যাবে। এদের মধ্যে রয়েছে তিন বন্ধু। তিনজনই মুসলিম। উদ্দেশ্য পূজা দেখা নাকি অন্য কিছু তারাই ভাল বলতে পারবে। কাহিনীর খাতিরে ধরে নেয়া যাক তাদের নাম আবুল, শরীফ ও বুলু।
এক সন্ধ্যায় তিন বন্ধু বেড়িয়ে পড়ল পূজা দেখতে। শীতকাল হওয়ায় চাদর দিয়ে নিজেদের শরীর ভালভাবেই মুড়িয়ে নিয়েছে। হালকায় কুয়াশা গলিয়ে তিন বন্ধু হেটে চলেছে পূজা মণ্ডপের উদ্দেশ্যে। সবচেয়ে বড় পূজার মণ্ডপটা কাছেই। যতই কাছাকাছি যাচ্ছে ততই পূজোর ঘণ্টার আওয়াজ জোড়াল হচ্ছে। রাস্তার ওদের মত অনেক ছেলে-মেয়ে আছে। ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে বেশি বেগ পেতে হল না।
এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে তিন বন্ধুর নজর পরে এক মেয়ের দিক। মেয়েটা তাদের চেয়ে একটু ছোটই হবে। অপূর্ব চেহারার মেয়েটার দিক থেকে তারাতো বটেই পূজোতে আসা কোন ছেলেই চোখ ফেরাতে পারছিল না। মেয়েটাকে দেখার পর তাদের আর কোনকিছুই ভাল লাগছিল না। বিশেষ করে বুলু যেন একটু খ্যাপাটেই হলে গেল। মেয়েটাকে বুলুর চাই-ই চাই। আবুল এবং শরীফ বুদ্ধি দিল, মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাবে সুযোগ মত। তুলে নিয়ে যাবার মত কাজ করতে বুলুর মন সায় দেয় না। কিন্তু শরীফ ও আবুলের জোরাজুরিতে মানাও করতে পারে না। বন্ধুদের কাছে কাপুরুষ হতে চায় না।
তারপর একদিন সুযোগ বুঝে তিনজনে মিলে ঐ মেয়েটিকে স্কুলে যাবার পথে পথ আটকে ফেলে। মেয়েটি বিপদ বুঝে চিৎকার শুরু করে। আবুল সাথে সাথে মেয়েটির মুখ চেপে ধরে। অন্য দুজন হাত-পা ধরে চ্যাংদোলা করে বয়ে নিতে চায়। মেয়েটি তখন প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাদের কাছ থেকে ছাড়া পেতে। হাত-পা ছোড়াছুড়ির কারনে ঠিকমত ধরে রাখা যাচ্ছে না। এক ফাকে মুখ থেকে আবুলের হাত ছুটে যেতেই মেয়েটি জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। সেই সাথে দূর থেকে কার যেন ডাক শোনা যায়। তিন-বন্ধু বুঝতে পারে আর জোরাজুরি করে লাভ নেই। তাই মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
এই ঘটনায় ঐ মেয়ের পরিবার মামলা দায়ের করে। মামলার খবর পেয়ে বুলু পালিয়ে যায়। বাড়ির সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখে সে। একে একে হাইস্কুল, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে পড়াশুনা শেষ করে সরকারী উঁচু পদে চাকুরী পাবার পর বাড়িতে আসে। আবুল আর শরীফ এলাকায় বখাটে হিসেবেই থেকে যায়।
ঘটনা-২
স্কুল পার হয়ে দেশের এক স্বনামধন্য কলেজে ভর্তি হয়েছে সবুজ আর ফরিদ। পড়াশুনায় তেমন একটা ভাল না হলেও মেয়েদের পিছে পিছে ঘোরার ব্যাপারে দু'জনের কোন ক্লান্তি নেই। দ্বিতীয় বর্ষে উঠার পর প্রথমবর্ষের এক মেয়েকে দারুণ পছন্দ হয় সবুজের। অপরূপা হবার কারণে সবুজের মত আরো অনেকেরই মেয়েটার দিকে নজর পড়ে। সবাইকে পাল্লা দিয়ে আর ফরিদের সাহায্যে মেয়েটার সাথে সবুজের সখ্যতা গড়ে উঠে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই তারা কলেজের পিছনের বিশাল দিঘীর পাশে বসে প্রেমালাপে মত্ত থাকত।
এদিকে মেয়েটির বড় বোনের দেবরও মেয়েটিকে ভালবাসে। কলেজে ভর্তির আগে তার সাথেই মেয়েটির প্রেম ছিল। ব্যাপারটা এমন ছিল কলেজে আসলে সবুজের সাথে প্রেম আর ঘরে গেলে বেয়াইয়ের সাথে প্রেম! বেয়াই ছিল খুবই চালাক। কিছুদিনের মধ্যেই সে বুঝতে পারে কোথাও কোন গণ্ডগোল হয়েছে। খোজ নিয়ে জানতে পারে মেয়েটা তার কলেজেরই আরেক ছেলের সাথে প্রেমে মত্ত। মেয়েটিকে হারানোর ভয়ে তার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে মেয়ের ফ্যামিলিতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু মেয়ের আপত্তির কারণেই হোক বা যেকোনো কারণেই হোক মেয়েপক্ষ আর এ বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না।
এতে সেই ছেলে উত্তেজিত হয়ে উঠে। এসিড ছুড়ে মারার হুমকি পর্যন্ত দেয় মেয়েটাকে। কিন্তু মেয়েটা পাত্তা দেয় নি। ভেবেছে অত সাহস কি আর হবে? কিন্তু একদিন সন্ধ্যায় মেয়েটি যখন তার পড়ার টেবিলে ছিল তখন সেই ছেলে জানালা দিয়ে এসিড ছুড়ে মারে। মেয়েটির পুরো মুখসহ শরীরের নানা জায়গা ঝলসে যায়। এসিড লেগে ছেলেটির হাতেও কনুই পর্যন্ত ঝলসে যায়। ঢাকা মেডিকেলে যখন যন্ত্রণায় মেয়েটি কাতরাচ্ছিল তখন সবুজ আর ফরিদ তাকে দেখতে যায়। তার রূপের আর তখন কিছুই অবশিষ্ট নেই। এসিডে ঝলসে যাওয়া বিকৃত চেহারা দেখে দু'জনেই শিউরে উঠে।
এই মেয়েটার আজো বিয়ে হয়নি। বিকৃত চেহারার মেয়েকে কেই বা বিয়ে করতে চায়? আর সেই ছেলে যে পালিয়েছে আর কোন খবর নেই। বড় ভাই তাকে আশ্রয় দেয় নি। আসলেও তাড়িয়ে দিয়েছে।
ঘটনা-৩
এবার আসি সাম্প্রতিক হবিগঞ্জের রুহুল আর অর্ণার কথায়। যারা জানেন তারাতো জানেন-ই, যারা জানেন না তাদের জন্য সংক্ষেপে বলি। প্রকাশ্যে এক স্কুল ছাত্রীকে মারধর ও তা ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোডের ঘটনায় কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সর্বত্র ছিঃ ছিঃ পড়ে যায়। পুলিশ দ্রুত রুহুলকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার পর রুহুলের কথায় বেড়িয়ে আসে এক চমকপ্রদ কাহিনী।
হবিগঞ্জ হল রুহুলের মামার বাড়ি। ঢাকা থেকে হবিগঞ্জ গিয়ে রুহুল ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়। এসময় পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী অর্ণার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই কথা তার গার্জিয়ান জানতে পারলে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু বাবা-মার কাছে অর্ণার সাথে যোগাযোগ করবে না-এমন শপথ করে রুহুল আবার হবিগঞ্জে ফিরে ক্লাস নাইনে বাণিজ্য শাখায় ভর্তি হয়। রুহুল অর্ণাকে এড়িয়ে চললেও অর্ণা তার পিছু ছাড়েনি। পরিবারে সিদ্ধান্তে রুহুল স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। টানা ২০ দিন সে স্কুলে যায় নি। তারপর তার ক্লাস টিচারের কথায় আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করে।
ঘটনার কিছুদিন আগে অর্ণা একটি ব্যাগে তার জামাকাপড় নিয়ে এসে রুহুলকে বিয়ে করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু বিয়ের বয়স হয়নি-এইধরনের অজুহাতে রুহুল তাকে ফিরে যায়। এতে অর্ণা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
এরপর অর্ণা হৃদয় নামের এক ছেলের সাথে সম্পর্ক করে এবং রুহুলের বিরুদ্ধে হৃদয়কে খেপিয়ে তোলে। এরপর একদিন হৃদয় তার বন্ধুদের নিয়ে অর্ণার স্কুলের সামনে রুহুলকে আটকিয়ে মারধর করে। অর্ণাও তখন পাশেই ছিল এবং তার বান্ধবীদের সাথে হাসিঠাট্টাও করছিল। এতে রুহুল চরম অপমানিত বোধ করে। তারপর থেকেই রুহুল প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে অর্ণাকে মারধর করে। এসময় ঘটনার ভিডিও করে রুহুলের বন্ধুরা। পরে সেই ভিডিও ফেবুতে আপলোড দেয় তার বন্ধুরা। রুহুল জানতে পেরে সাথে সাথে ডিলিট দেয়। কিন্তু ততক্ষণে ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। তারপরের ঘটনা তো উপরে বললামই।
রুহুলের শ্রেণী শিক্ষক অবশ্য রুহুলকে ভদ্রছেলেদের একজন বলে উল্লেখ করেছেন।
প্রথমোক্ত দুই ঘটনা আমার কলিগদের মুখে শোনা। আর ৩য় ঘটনাটি মিডিয়ার প্রকাশিত। বিস্তারিত পাবেন আজকের আমারদেশের প্রথম পাতায়।
আমার লেখার উদ্দেশ্য কাউকে দায়ী করা নয়। এধরনের ঘটনার জন্য কে দায়ী সে-ই আলোচনায় আমি যাব না। প্রথমোক্ত ঘটনা দুটি বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কারণ যাদের কাছে শুনেছি তারা দু'জনেই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলায় তাদের কোন লাভ নেই।
শেষোক্ত ঘটনায় প্রথমদিকে পাবলিক রিএকশন ছিল একরকম। পুরো ঘটনা জানার পর এখন অন্যরকম হবার কথা। অবশ্য রুহুল সত্য বলছে এমনটা এখনো প্রমাণিত হয় নি। সে ফেঁসে গিয়েছে। এখন নিজেকে সেভ করতে নানান কথা বলবে সেটাই স্বাভাবিক। অর্ণা, হৃদয় ও রুহুলের বন্ধুদের জেরা করলে প্রকৃত সত্য বোঝা যাবে।
মূলকথা যেটা বলতে চাই সেটা হল, প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ায় কিছু পেলেই তা বিশ্বাস না করা। সাংবাদিকরাও মানুষ। তারা স্থলণের ঊর্ধ্বে নন। বরং তারা প্রায়ই ফেইক নিউজ প্রদান করে থাকেন। এমনকি কবর থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান নাকি জন্মাষ্টমী উপলক্ষে বাণী দেন!
দোষী যে-ই হোক তার শাস্তিই কাম্য। সাংবাদিকদের দরকার খবর। খবরকে পত্রিকায় বা টিভিতে প্রকাশিত/প্রচারিত "সংবাদ" করাই তাদের কাজ। তাদেরকে এ কারণেই বেতন দেয়া হয়। যে যত ভালভাবে এই কাজটি করতে পারে সে তত ভাল সাংবাদিক। কাজেই আমার পরামর্শ থাকবে কোন সাংবাদিকের সাথে যখন কথা বলবেন (যেটা প্রকাশিত হতে পারে) তখন মোবাইলের অডিও/ভিডিও রেকর্ডার চালু করে পুরো কথাবার্তা রেকর্ড করে রাখবেন। এখনকার প্রায় সব মোবাইলেই অডিও/ভিডিও রেকর্ড করা যায়। কাজেই আপনার কথার উপর ভিত্তি করে সাংবাদিক যদি কোন খবর কে "সংবাদ" করে খবর পালটে দেয় তবে তাকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করার হাতিয়ার আপনার কাছে থাকবে। অবশ্য সাংবাদিক আর আমি যদি একই ক্যাটাগরির হই তাহলে আর এই সূত্র খাটবে না।
অশুভ রাত্রি!
No comments:
Post a Comment