বায়োমেট্রিক পদ্ধতি সম্পর্কে বলার আগে জাতীয় পরিচয় পত্রের কথা একটু স্মরণ করি। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার জানা ছিল তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে প্রত্যেক মানুষের একটি সতন্ত্র সনাক্তকরন নম্বর থাকাটা জরুরী। একই নাম অনেকের হতে পারে। তাই একক পরিচয়ের জন্য একক নাম্বার রাখার বিষয়টা বিভিন্ন মুভি, সায়েন্স ফিকশনে দেখেছি। কাজেই যখন সরকারের তরফ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেবার ঘোষনা দেয়া হয়েছিল তখন আগ্রহ সহকারে নিবন্ধন করতে যাই। সবার মত সেখানে আমার পূর্ণ নাম, পরিচয়, মুখমন্ডলের ক্লোজ ছবি, সনাক্তকারী চিহ্ন, আঙুলের ছাপসহ অনেক তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়।
জাতীয় পরিচয় পত্র হাতে পাবার পর অনেকেরটা দেখলাম নামের বানান ভুল, পিতার/মাতা/স্বামীর নাম বা নামের বানান ঠিক নেই, ছবি ঝাপসাসহ অসংখ্য সমস্যা।আধাদক্ষ, অদক্ষ লোক দিয়ে কাজ করালে যা হয় আর কি। জাতীয় পরিচয় পত্র হবার পর অনেক কাজেই পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু"একমাত্র" জরুরী উপাদান করা হয় নি।
উদাহরণস্বরূপ, পাসপোর্ট করানোর সময় যখন পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগল তখন পলাশ থানা থেকে আমার খোজ করা হল। আমি তখন পলাশেই ছিলাম। মোবাইলে ফোন আসার পর ইনভেস্টিগেটরের সাথে দেখা করলাম। সে প্রথমেই আমার জাতীয় পরিচয়পত্র চাইল। পরিচয়পত্র দিতে চাইলে বলল, জন্মনিবন্ধন আর চেয়ারম্যান সার্টিফিকেটও লাগবে। তখন জন্মনিবন্ধন সবে শুরু হয়েছে। হাই অফিসিয়ালদেরই জন্মনিবন্ধন নেই, আর আমিতো .........! আমার সাথে আমার এক বন্ধু ছিল। সে বুঝল এইগুলো পুলিশের টাকা খাওয়ার ধান্ধা ছাড়া কিছুইনা। সে কিছু টাকা ঐ ইনভেস্টিগেটরের হাতে দিল। এরপর জন্মনিবন্ধনও লাগল না, আবার চেয়ারম্যানও মনে হয় অক্কা পেয়েছিল! বলাই বাহুল্য, ৫ বছর হয়ে গেলেও সেই পাসপোর্ট এখনো পাই নি। এটাও বলে দিচ্ছি, কিছু টাকা বাড়িয়ে পুলিশকে দিলে কোন কাগজপত্র ছাড়াই পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন।কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম! যাই হোক, বর্তমান জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম, ঠিকানা, সই, ব্লাড গ্রুপ এ তথ্যগুলো আছে। আর পরিচয়পত্র করানোর সময় আঙুলের ছাপ নেয়া হয়েছিল। সেই ছাপ অবশ্যই ডাটাবেসে সংরক্ষিত থাকার কথা। নাহলে আঙুলের ছাপ নেয়ার কোন যৌক্তিকতা থাকত না। এখন আমি যখন কোন সীম কিনব বা পুরাতন কোন সীম রেজিস্ট্রেশন করব, তখন জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে। আর জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার পাওয়া গেল আমার আঙুলের ছাপও পাওয়া যাবে। কারন ডাটাবেসে তা আছে। কিছুদিন আগে যখন জাতীয় পরিচয়পত্রের দ্বারা সীম নিবন্ধনের তোড়জোড় শুরু হল তখন আমার মত অসংখ্য মানুষ (প্রায় সবাই বলতে চাই) তাদের সকল নিবন্ধিত/নিবন্ধিত সীম এস এম এস, মোবাইল এপস অথবা সরাসরি কাস্টমার কেয়ারে গিয়ে পুনরায় নিবন্ধন করেছেন। এস এম এস , মোবাইল এপস ব্যবহারের কারনে অপারেটরদের পয়সা দিতে হয়েছে।
আবার যারা সশরীরে হাজির হয়েছেন তাদের যাতায়াত খরচ, কায়িক শ্রম ও সময়ের অপচয় হয়েছে। মোদ্দা কথা, বিপুল অংকের টাকার হাতবদল হয়েছে। এই টাকা কার পকেট থেকে গিয়েছে? সরকারের? নাকি আমার আপনার?এখন আবার শুরু হয়েছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে পুনঃ রেজিস্ট্রেশন। এখানেও যে বিরাট অংকের টাকার খেলা হচ্ছে সেটা কি ভেঙে বলতে হবে? আল্টিমেটলি লুজার কারা? সরকার/অপারেটর? নাকি আমি-আপনি? বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন যখন করতেই হবে তখন গতবারের রেজিস্ট্রেশন কেন নেয়া হল? একবারেই কেন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে করানো হল না? উত্তর যদি হয় টেকনলজি ছিল না, তবে বলতে হয় আর দু'টো মাসঅপেক্ষা করা হল না কেন?আমাদের কি খেয়ে দেয়ে কোন কাজ নেই? কিছুদিন পর পর গাটের পয়সা খরচ করে ছবি, আইডির ফটোকপি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করাই আমাদের একমাত্র কাজ? কিছুদিন পর হয়ত পাছার ছাপ দেয়ার ঘোষণা আসবে। তখন আবার পাসপোর্ট সাইজ ছবি, আইডির ফটোকপি দৌড়ে নিয়ে গিয়ে প্যান্ট খুলে পাছার ছাপ দিয়ে আসব। তাই নয় কি?
বিজনেসের ক্লাস যখন করি তখন কথায় কথায় স্যার একদিন প্রফেশনালিজমের কথা বলেছিলেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, কারো অফিস যদি হয় ৮ টা থেকে ৫ টা তবে সে ঠিক সকাল ৮টায় অফিসে আসবে, ঠিক ৫টায় বেড়িয়ে যাবে। ৫ টা ১ মিনিটে নয়। কারন অফিস আমাকে ১ মিনিটের টাকা দিবে না। তাই অফিসে এক মিনিট বেশি থাকা কোন প্রফেশনালের কাজ নয়।বাংলাদেশে অবশ্য প্রফেশনালিজমের প্র্যাকটিস নেই। কিন্তু বাংলাদেশে যেসব বিদেশী বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আছে তাদের মধ্যে প্র্যাকটিস আছে। আমেরিকায় পিতৃত্বকালীন ছুটি আছে সম্ভবত ১৫দিন। কাজেই বাংলাদেশে যে আমেরিকান কোম্পানি আছে সেটার কর্মচারীরা১৫ দিন ছুটি পান। (ব্যতিক্রম থাকতে পারে) টেলিটক ছাড়া অন্য মোবাইলে অপারেটরগুলো এদেশি নয়। কাজেই ধরে নেয়া যায়, তারা প্রফেশনাল এবং সবকিছুকেই বিজনেস হিসেবে দেখে। কাজেই বার বার সীমের নিবন্ধন, বায়োমেট্রিক নিবন্ধন কোম্পনিগুলো ফ্রীতে সরকারকে করে দিচ্ছে এই ভাবনাটা আমার মতে বোকার মত। এখানে অবশ্যই তাদের কোন স্বার্থ বিদ্যমান। আর সেই স্বার্থ অবশ্যই আমাদের মত গ্রাহকদের বিপক্ষে যাবে। অপারেটরগুলো কোনদিন কোনকিছু গ্রাহকদের স্বার্থে নিঃস্বার্থভাবে করেছে এমন কিছু যদি আপনার জানা থাকে তবে জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
গতকাল এক জ্ঞানী লোকের কথায় বুঝলাম, সে মনে করে এই আঙুলের ছাপ দেয়ার দ্বারা নাকি সরকারের খুব সুবিধা হবে। কেমন সুবিধা? সরকার নাকি কে কোথায় আছে ততক্ষনাৎ বের করতে পারবে। ইন্ডিয়াতে নাকি হরদম এমন হচ্ছে। তার কথা শুনে আমি নগদে টুট টুট হয়ে গেলাম। কাউকে জিপিএসের মাধ্যমে ট্র্যাক করতে যে আঙুলের ছাপ লাগে না- এই কথাটা তাকে বোঝানোর মত জ্ঞান-বুদ্ধি আমার নেই বলে দু-একটি কথা বলেই ক্ষ্যান্ত দিয়েছিলাম।একজনের ১ টি আইডি কার্ড। ধরাযাক, আইডি কার্ডের বিপরীতে ১০ টি সীম নিবন্ধিত। এই সীমগুলো যেখানেই থাক বা হারিয়ে যাক তার মালিককে তো পাওয়া যাবে। কাজেই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সীম কেন নিবন্ধন করতে হবে?আরো ধরা যাক, কোন ঘটনাস্থলে কারো আঙুলের ছাপ পাওয়া গেল। জাতীয় পরিচয় পত্রের ডাটাবেস থেকে তার পরিচয় উদ্ধার করা হল। পরিচয় পাবার পর সে কোন সীম ব্যবহার করে সেটাও জানা গেল। সেই সীমের মাধ্যমে তার পজিশনও জানা যাবে। সীমের সাথে আঙুলের ছাপের সম্পর্ক এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঢুকল না। দুঃখিত।আরো ভয়াবহ ব্যাপার হল, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সীম নিবন্ধনের সময় নাকি জাতীয়পরিচয় পত্রের ডাটাবেসের সাথে আঙুলের ছাপ মিলছে না। তখন আর সীম রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে না। এখন ভেবে দেখার বিষয় হল, আমি কার হাত নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি? আর আমার হাত-ই বা কে নিয়ে গেল?কারো পেতে রাখা জটিল ফাঁদে পা দিচ্ছি কিনা ভালভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
ফী আমানিল্লাহ!
No comments:
Post a Comment