ক্রিকেট পছন্দ করে অথচ ডাকয়োর্থ-লুইস (D/L) মেথডের নাম শোনে নি এমন মানুষ বোধকরি কমই পাওয়া যাবে। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বলুন তো ডাকয়োর্থ লুইস মেথড আসলে কি, কিভাবে কাজ করে-তখন কতজন সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারবে? প্রকৃতপক্ষে উত্তরটা এত সহজও নয়।
সোজা কথায় বললে D/L মেথড দ্বারা কোন ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন যদি কোন অনাকাঙ্খিত বাধা (মূলত বৃষ্টি) তৈরি হয় এবং পূর্ব নির্ধারিত ওভার কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে প্রথম দলের স্কোরের উপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় দলের জন্য টার্গেট নির্ধারন করার এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নিখুঁত/কার্যকর পদ্ধতি। এর আগে Average Run Rate এবং Most Productive Over দুটি পদ্ধতিসহ অন্যান্য পদ্ধতি চালু ছিল। অন্যগুলোর তুলনায় Average Run Rate এবং Most Productive Over পদ্ধতির কার্যকারিতা তুলনামূলক বেশি থাকলেও কতটা বাস্তব সম্মত ছিল সেটা দু'টি উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে।
প্রথমে ১৮৮৯ সালের অস্ট্রিলিয়ার ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালের কথাই বলতে হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রিলিয়া বৃষ্টিবিঘ্নিত দিনে ৩৮ ওভার ব্যাট করে ৪ উইকেটে ২২৮ রান তুলতে সমর্থ হয়। পরে বৃষ্টির কারনে টার্গেট পুননির্ধারণ করে ৩১.২ ওভারে ১৮০ করা হয়। পুনরায় প্রায় দেড় ঘন্টা বৃষ্টি হয় এবং Average Run Rate মেথড ব্যবহার করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য ১১.২ ওভারে ৬১ রানের নতুন লক্ষ স্থির করা হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ খুব সহজেই ২ উইকেট খরচায় এবং ২৮ বল বাকি থাকতেই অভিষ্ট লক্ষে পৌছে যায়।
এতে অস্ট্রিলিয়ার তৎকালীন অধিনায়কসহ পুরো অস্ট্রিলিয়ান মিডিয়ার সমালোচনার মুখে Average Run Rate মেথড বাতিল করে Most Productive Over মেথড চালু করা হয়। এই পদ্ধতির বিরুদ্ধেও প্রশ্ন উঠে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। ইংল্যান্ড এবং সাউথ আফ্রিকার মধ্যে অনুষ্টিত এই সেমিফাইনাল ম্যাচেও বার বার বৃষ্টি বাধার সৃষ্টি করে। ইংল্যান্ডের ৪৫ ওভারে ২৫২/ ৬ তাড়া করতে নেমে দক্ষিন আফ্রিকার যখন ১৩ বলে ২২ রান দরকার ছিল তখন বৃষ্টি নামে। Average Run Rate মেথড ব্যবহার করে ১৩ মিনিটের বৃষ্টির কারনে দক্ষিন আফ্রিকার জন্য নতুন লক্ষ দেয়া হয় ১ বলে ২১ রান! ১৩ বলে ২২ রান যেখানে খুবই সম্ভব সেখানে ১ বলে ২১ রান অসম্ভবেরও উপরে! ইংল্যান্ড জয়ী হয় এবং Average Run Rate মেথড প্রচন্ড সমালোচনার সম্মুক্ষীন হয়।
ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ বলেন, "আমার এখনও মনে পড়ে রেডিওতে ক্রিস্টোফার মার্টিন-জেঙ্কিংস বলছিলেন, 'অবশ্যই কাউকে এর চেয়ে ভাল কোন পদ্ধতি বের করতে হবে' এবং আমি বুঝতে পারি একমাত্র গানিতিকভাবেই এর সমাধান করতে হবে।"
জ্বী, ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড যাদের আবিস্কার তাদের একজন এই ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ। অপরজন হলেন টনি লুইস। তারা দু'জনেই বৃটিশ পরিসংখ্যানবিদ ছিলেন। তাদের অবসর গ্রহনের পর অধ্যাপক স্টিভেন স্টান D/L মেথডের রক্ষনা-বেক্ষন, সংস্কার ও উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তখন থেকে এই মেথডকে Duckworth-Lewes-Steven বা D/L/S মেথড নামে অভিহিত করা হয়। এই পদ্ধতি সীমিত ওভারের ম্যাচগুলোতে প্রয়োগ করা হয়।
D/L/S মেথডের হিসাব-নিকাশ খুব জটিল। তার বিশেষ সফটওয়ারের ব্যবহার করে খেলায় অংশগ্রহনকারী দলগুলোর জন্য টার্গেট নির্ধারণ করা হয়। তারপরও কিছু মূলনীতিতো আমরা আলোচনা করতেই পারি।
কোন দল যখন ব্যাট করতে নামে তখন তার স্বাভাবিকভাবে তার হাতে থাকে ৫০ ওভার ও ১০ উইকেট। এই ওভার ও উইকেটকে আমরা ঐ দলের সম্পদ বা রিসোর্স বলতে পারি। দুই সম্পদ মিলে মোট ১০০% হিসাব করা হয়। ওভার ও উইকেট কমার সাথে সাথে শতকরার এই পরিমাণ কমতে থাকে। মূল সমীকরণটিঃ
Team2's par score =
Team1's score X (Team2's Resources / Team1's Resources)
নোটঃ
১। Par Score বলতে স্কোরের সমতা বোঝানো হয়েছে। স্বভাবতই এই সমীকরনের সমাধান ভগ্নাংশে আসে। কাজেই পরবর্তীতে পূর্ণ সংখ্যাকে টার্গেট এবং আগের পূর্ণ সংখ্যাকে প্রথমদলের রান সংখ্যা ধরা হয়।
২। যদি প্রথমে ব্যাট করতে নামা দল পুরো ওভার ব্যাট করতে পারে তাহলে তারা তাদের ১০০ ভাগ সম্পদ ব্যবহার করতে পেরেছে ধরা হয় এবং সমীকরণটি দাঁড়ায়
Team2's par score = Team1's score X Team2's Resources
সম্পদ বা রিসোর্সের শতকরা হিসাব করার মূলনীতিগুলো হচ্ছেঃ
১। যদি খেলা শুরু হবার আগেই কোন কারনে ওভার কাটা হয় তাহলে এই পদ্ধতির দ্বারা টার্গেট পরিবর্তন করা হবে না। কারণ দু'দুলেই সমান সংখ্যক ওভার ও উইকেট আছে এবং ওভার কাটা যারা বিষয়টি জানাই আছে।
২। প্রথম দলের ব্যাটিং শেষ হলেই দ্বিতীয় দলের জন্য টার্গেট হিসাব করা হবে।
৩। প্রথম ইনিংস চলাকালে যদি কোন কারনে ওভার কমাতে হয় তাহলে D/L/S পদ্ধতি দ্বারা প্রথম ইনিংস শেষ হলে স্কোর পুনঃনির্ধারণ করা হবে এবং দ্বিতীয় দলের জন্য নতুন লক্ষ স্থির করা হবে।
৪। যদি প্রথম ইনিংস চলাকালে ওভার কমাতে হয় তাহলে D/L/S পদ্ধতির মাধ্যমে দ্বিতীয় দলের জন্য পুনঃনির্ধারণকৃত লক্ষ্য সাধারনত বেড়ে যায়। কারন দ্বিতীয় দলের জন্য তখন সম্পদ তুলনামূলক বেশি থাকে। যদি প্রথম দলের কোন উইকেটের পতন নাও হয় তবুও এই বাড়তি রান যৌক্তিক কারণ প্রথম দল ইনিংসের শুরুতে যতটা সম্পদ (ওভার ও উইকেট) পাবে ভেবেছিল তা পায় নি।
৫। প্রথম দল যদি জানত যে তাদের ইনিংস ছোট (ওভার কমানো) হবে তাহলে তারা প্রথম থেকে উইকেটের কথা চিন্তা না করে সমানে ব্যাট চালাত। এতে তাদের স্কোর বাড়ত। তারা পুরো ওভার খেলার আশায় উইকেট ধরে খেলে। কিন্তু ইনিংস ছোট করার পর দ্বিতীয় দলের জন্য উইকেট ধরে খেলার প্রয়োজন নেই। তারা আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে পারে। কাজেই দ্বিতীয় দলের জন্য রান বাড়ানোটা প্রথমদলের ব্যাট না করতে পারাকে পুষিয়ে দেয়।
৬। দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর পূর্বে অথবা চলাকালীন যদি খেলা বিঘ্নিত হয় কিংবা ওভার কমানো হয় তাহলে দ্বিতীয় দলের জন্য টার্গেট কমানো হবে তাদের সম্পদের শতকরা হারের উপর ভিত্তি করে। দ্বিতীয় ইনিংস চলাকালীন যদি একাধিকবারও খেলায় বিঘ্ন ঘটে তবে একই নিয়মে প্রতিবার টার্গেট কমানো হবে।
৭। পুরো খেলাতেই যদি বার বার বিঘ্ন ঘটে তবে টার্গেট বাড়তেও পারে, কমতেও পারে। এটা নির্ভর করবে কোনবার কত বেশি সময় ধরে বিঘ্ন ঘটেছে এবং এর প্রভাব কি হয় তার উপর।
এতকিছুর পরও D/L/S পদ্ধতি যে পরিপূর্ণ সঠিক তা নয়। এরও অনেক সমালোচনা আছে। একটু এদিক সেদিক হলে পুরো ফলাফল পালটে যেতে পারে। ২০০৯ সালে ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার One Day খেলার সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোচ জন ডাইসন আলোকসল্পতার কারনে তার খেলোয়ারদের ফিরিয়ে ড্রেসিং রুমে ফিরিয়ে আনেন কারন তিনি হিসেব করেছিলেন যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ রানে জিতে যাবে D/L/S মেথোডে। পরবর্তীতে দেখা গেল শেষ বলে উইকেট খোয়ানোর কারনে পুরো হিসেব ওলট -পালট হয়ে গিয়েছে। অবশেষে ম্যাচ রেফারি জাভাগাল শ্রীনাথ ইংল্যান্ডকে জয়ী ঘোষনা করেন। এছাড়াও সময়ের সাথে সাথে ক্রিকেট খেলার ধরন পালটে যাচ্ছে। T-20 আসার পর ক্রিকেটের বোলিং, ব্যাটিং ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মাত্র একটি ওভার (এক ওভারে ২৪-৩০ রান হওয়া খুব সাধারন ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে) পুরো খেলার মোড় ঘুড়িয়ে দিতে সক্ষম। D/L/S জটিল হিসাব-নিকাশেও এই বাস্তবতা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এরচেয়েও পরিপূর্ণ কোন পদ্ধতি প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত D/L/S-ই একমাত্র ভরষা তা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেখা যাক, সামনে কি হয়!
No comments:
Post a Comment