নিজের জীবনের আরো কিছু কথা শেয়ার করি। এবারের কথাগুলো তাবলীগ সম্পর্কিত। প্রায়ই হোমফিডে জ্ঞানী ব্যক্তিদের তাবলীগ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য, পোস্ট দেখতে পাই। যারা তাবলীগের সাথে শত্রুতা পোষন করেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার নেই। তবে যাদের মনে সংশয় আছে তাদের ধারনা পরিষ্কার হবে ইন শা আল্লাহ!
তখনো বালেগ হইনি। মাঝে মাঝে নামায পড়তে যেতাম মসজিদে। বিশেষ করে এশার নামাযে। মূলত রাতের পড়াশুনা থেকে ক্ষনিকের জন্য নিস্তারপেতেই যাওয়া। এশার আযান দিলেই মার কাছে অনুমতি নিয়ে জামাতের জন্য বের হয়ে যেতাম দুই ভাই মিলে। বাবা-মা দু'জনেই নামাযী থাকাতে নামাযের ক্ষেত্রে কখনো বাধার সম্মুখীন হইনি। হয়ত মসজিদে নামায পড়তে যেয়েই তাবলীগের বড়ভাইদের নজরে পড়ি।
সরকারী ছুটির দিনগুলোকে টার্গেট করে বড়ভাইরা কঠিন মেহনত করতেন। আমাদেরমত পিচ্চিদের অভিভাবকের পিছনে। ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ১৬ ডিসেম্বর ইত্যাদি তারিখে স্কুল বন্ধ থাকত। এলাকার মুরব্বী এবং বড় ভাইরা তখন আমাদের অভিভাবকদের রাজি করিয়ে আমাদের একদিনের জামাতে নিয়ে যেতেন। সকালে জামাত বের হবে, আবার এশার নামায নিজদের মহল্লার মসজিদে পড়বে। ১৫০ থেকে ২০০ জনের বিশাল জামায়াত হত। আশেপাশের কোন এক মসজিদে গন্তব্য ঠিক করা হত যেন হেটেই যাওয়া যায়। একজনের পর একজন লাইন ধরলে বিরাট লাইন হত। উচ্চস্বরে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্ললাহ, আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আশপাশটা সরব হয়ে উঠত। জনপ্রতি খাওয়ার খরচ ছিল ২০ টাকা। মসজিদের পৌছে যার যার প্রয়োজন ছিল ওযু করে নিতাম। তারপর বসে যেতাম মসজিদের ভিতরে। এদিকে মসজিদের বারান্দায় ভাইদের একগ্রুপ কাজে লেগে যেতেন। সাথে আনা বড় বড় থালে মুড়ি, চানাচুর, বিস্কিট, কলা দেয়া হত নাস্তা হিসেবে। সবাই গোল হয়ে বসে নাস্তা খেতাম।
তারপর বড় ভাইরা আমাদের নামায প্র্যাকটিস করাতেন। কিভাবে তাকবীরে তাহরীমা বলতে হবে। কিভাবে রুকু, সিজদায় দিতে হবে, কিভাবে সালাম ফিরাতে হবে। ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে সূরা ফাতিহা, সূরা লাহাব, সুরা এখলাস, সূরা ফালাক্ব, সুরা নাস মশক করতাম।কিভাবে ওযু শুদ্ধভাবে করতে হবে, কিভাবে টয়লেট সারতে হবে-এসব বিষয়ের খুটিনাটি তাবলীগ থেকেই শিখেছিলাম।
এরই মধ্যে যোহরের নামাযের সময় হয়ে যেত। বড় ভাইরা বার বার সাবধান করে দিতেন যেন, এলাকার মানুষ আসলে তাদেরকে সম্মান দেখিয়ে নামাযের জায়গা করে দেই। তাদের সাথে যেন কোন রকম বেয়াদবি না করি কেউ। নামাযের পর দুপুরের খাওয়ার পালা। খাবার হয়ত তখনো এসে পৌছে নি। তখন কোন এক বড় ভাই সাহাবাদের হৃদয়বিদারক ঘটনাসমূহ আমাদের শোনাতেন। তারা ইসলামকে আমাদের পর্যন্ত পৌছাতে কত কষ্ট করেছেন তার বর্ণনা শুনতে শুনতে আমাদের চোখ ছলছল করত।
বিরিয়ানি পৌছে যেত। একই থালে ৫-৬জন করে বসে যেতাম। ঘরে সবার জন্য আলাদা আলাদা প্লেট। একই প্লেটে ৫-৬ জন খাওয়ার মধ্যে যে "ঘেন্নার" বা অস্বস্তির কিছু নেই, আর থাকলেই সেটাতে পাত্তা না দেয়াটা তাবলীগ থেকেই শিখেছি। এরই মধ্যে কোন ভাই হয়ত তার মাংসের টুকরাটা আরেকজনকে খাইয়ে দিলেন। আবার কেউ হয়ত তাকে আলুর টুকরাটা তুলে দিলেন। এভাবে আমাদের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধি পেত। খাওয়ার পর কিছুক্ষন বিশ্রাম। আছরের পর কয়েকজনের একটা দল মহল্লার ঘরে ঘরে গিয়ে দাওয়াত পৌছে দিত, মসজিদের আসার দাওয়াত দিত। মাগরিবের পর যে কথা গুলো হত তার সারবস্তু হল, আমি যেমন নামাযে আসতে পেরেছে আমার পাশের ভাইকে নামাযে নিয়ে আসা আমার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হবে। এমনিভাবে সমগ্র উম্মতের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম)এর যে দরদ, মায়া, ভালবাসা ছিল এই দরদ, মায়া, ভালবাসা নিজের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে। দাওয়াত পৌছাতে হবে। নিজে বাঁচতে হবে, পরিবারকেও বাঁচাতে হবে।
এরপর আবার জিকির করতে করতে নিজেদের এলাকার মসজিদে ফিরে আসা। এশার নামাযের পর ভাইরা বলে দিতেন, নিয়মিত জামাতে শরিক হতে হবে। মাগরিগের নামাযের পর ছাত্রদের জন্য ৫ মিনিট তালিম হয়। তালিমে বসতে।
বড়ভাইদের মেহনতের ফলে ধীরে ধীরে নামাযের অভ্যাস গড়ে উঠে। শিখতে থাকি কিভাবে নেতৃত্ব মানতে হয়, কিভাবে নিতৃত্ব দিতে হয়। তাবলীগ আমাকে শিখিয়েছে-
> ঈমানী হালতে থাকা এবং ছতর ঢাকা রাখা পুরুষের জন্য সর্বাবস্থায় ফরজ।
> চুল সমানভাবে রাখা, গোফ ছাঁটা, মেসওয়াক করা, দাড়ি রাখা, অবাঞ্চিত লোম
সময়মত পরিস্কার করা, হাত পায়ের নখ কাটা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন বিষয়।
> রাস্তার ডাক দিয়ে চলা, নজরের হেফাজত করা, যৌবনের হেফাজত করা, নারীদের নারী হিসেবে দেখা (সম্মান করা)
> কারো ভুল ধরা যাবে না, কাউকে কষ্ট দেয়া যাবে না, কারো সম্পর্কে খারাপ ধারনা করা যাবে না।
> খাবারের দোষ ত্রুটি বর্ণনা থেকে বিরত থাকতে হবে, যে রান্না করেছে সে অনেক কষ্ট করে খাবার বানিয়েছে, বদনাম করলে সে কষ্ট পেতে পারে।
> মুসুল্লিদের জুতা সোজা করে দেয়াও তার উপর এহসানের একটা রুপ
ইত্যাদি অসংখ্য বিষয়।
কেউ যদি নিজের এলাকার মসজিদে কোন তাবলীগের বয়ান শুনে এবং কাকরাইল মসজিদের বয়ান শুনে তবে সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করবে যে, দুই জায়গাতেই একই কথা বলা হচ্ছে। সেই পুরনো কথা, “এই কাজ আমার, এই কাজ আমাকেই করতে হবে”।
তাবলীগের মধ্যে একই জামাতে বড়লোক, গরীব, রিকশাওয়ালা, আলেম, ছাত্র, কৃষকসহ বিভিন্ন ধরনের মানুষ পাওয়া যাবে। সবার উদ্দেশ্য একটাই নিজে বাঁচা, নিজের পরিবারবর্গকে বাঁচানো। এখানে কে বিএনপি, কে আওয়ামীলীগ, কে জামায়াত, কে চরমোনাই মুরিদ দেখা হয় না। কোন রাজনৈতিক দলকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থনও করা হয় না। তাবলীগের “রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি” না থাকায় অনেকেই এর সমালোচনা করে থাকেন। করতেই পারেন। তাবলীগ পরিপূর্ণ ইসলামী আন্দোলন, সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন-এই দাবী কেউ করেনি।
তাবলীগের কারনে ইসলামী জীবনের কাছাকাছি থাকা আমার জন্য সহজ হয়েছে। কেউ অশ্রাব্য কোন কথা বলার আগে হিসেব করে বলেছে। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের বিরূপ মন্তব্যের পরেও দাড়ি রাখতে পেরেছি। স্কুল-কলেজে মেয়েরা দূরে থেকেছে, আমিও দূরে থাকতে পেরেছি। হালাল-রুজীর ব্যবস্থা হয়েছে। বিয়ে মোটামুটি ইসলামীভাবে করতে পেরেছি। আল্লাহ তায়ালাই সহজ করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
এখন ঈমান নিয়ে মরতে পারলেই হয়!
No comments:
Post a Comment