প্রথমে দুটো হাদিস বর্ণনা করে নেই।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর শক্তিধর মহান প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সৎ কাজ ও অসৎ কাজ লিখে দিয়েছেন। এরপর তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। অতএব যে ব্যক্তি কোন সৎ কাজের সংকল্প করে তা করেনি, তাকে আল্লাহ্ তাআলা একটি পূর্ণ নেকীর সওয়াব দান করেন। আর যদি সংকল্পের পর এ কাজ করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত, এমনকি তার থেকেও বেশি গুণ সওয়াব দান করেন। আর যদি কোন গুনাহর কাজের সংকল্প করে তা না করে, তাহলে আল্লাহ্ তার বিনিময়ে একটি পূর্ণ সওয়াব লিখে দেন। আর যদি সংকল্প করার পর সে গুনাহর কাজটি করে, তাহলে আল্লাহ্ তাআলা তার একটি মাত্র গুনাহ লেখেন। তথ্যসূত্রঃ (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলতে শুনেছিঃ অতীতকালে তিনজন লোক কোথাও চলার পথে রাত যাপনের জন্য তাদেরকে এক পর্বত গুহায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তারা সেখানে প্রবেশ করার পর পাহাড়ের চূড়া থেকে একখানা পাথর খসে পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। এরপর তারা বলল-"তোমরা একমাত্র আল্লাহর নিকট তোমাদের খাঁটি নেক আমলকে ওসীলা করে দো'আ করলে, পাথরের এ বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পার।" তাদের একজন বললঃ হে আল্লাহ্! আমার পিতামাতা ছিলেন খুবই বৃদ্ধ। আর আমি তাঁদেরকে আমার পরিবার-পরিজনের আগেই দুধ পান করিয়ে দিতাম। একদিন জ্বালামী কাঠের সন্ধানে আমাকে বহুদূর যেতে হল এবং যথাসময়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারলাম না, এমনকি তাঁরা ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি তাঁদের রাতে খাবার জন্য দুধ দোহন করে এনে দেখি তাঁরা ঘুমিয়ে আছেন। অতঃপর আমি তাঁদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা এবং তাঁদের আগে পরিবার-পরিজনকে দুধ খাওয়াতেও আমি অপছন্দ করলাম। অতএব আমি দুধের পেয়ালা হাতে নিয়ে তাঁদের জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। অপরদিকে আমার সন্তানগুলো পায়ের নিকট ক্ষুধায় গড়াগড়ি করছিল। এমতাবস্থায় ভোর হয়ে গেল। তারপর তাঁরা জেগে উঠে দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজটি আপনারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করে থাকি তবে এ পাথরের কারনে আমরা যে বিপদে পড়েছি তা থেকে আমাদের মুক্তি দিন। এত পাথরখানা কিছুটা সরে গেল বটে, কিন্তু এর ফাঁক দিয়ে তারা বের হতে পারল না। দ্বিতীয় ব্যক্তি বললঃ হে আল্লাহ! আমার এক চাচাত বোন ছিল। আমি তাকে সর্বাপেক্ষা বেশি ভাল বাসতাম। অন্য এক বর্ণনায় আছে, পুরুষ নারীকে যত বেশি ভালবাসতে পারে আমি তাকে তত বেশি ভালবাসতাম। অতপর আমি তার সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করলাম। সে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। এমনকি এক দুর্ভিক্ষের বছর সে আমার নিকট এল। সে আমার নিকট নিজেকে নিরালায় অর্পণ করবে শর্তে আমি তাকে ১২০ টি স্বর্ণমুদ্রা দিলাম। এতে সে রাজী হয়ে গেল। আমি যখন তাকে নিরালায় পেলাম, অন্য এক বর্ণনায় আছেঃ যখন আমি তার দু'পায়ের মাঝখানে বসলাম, তখন সে বললঃ "আল্লাহকে ভয় কর এবং অনাধিকারে আমার কুমারীত্ব নষ্ট করো না।" তখনই আমি তার থেকে ফিরে গেলাম। অথচ মানুষের মধ্যে সে আমার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়ে ছিল। আমি তাকে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলাম তাও ছেড়ে দিলাম। হে আল্লাহ! আমি যদি এ কাজ আপনরই সন্তুষ্টির লাভের উদ্দেশ্যে করে থাকি, তবে আমাদের এ বিপদ দূর করে দিন। এতে পাথরখানা আরও কিছুটা সরে গেল। কিন্তু তাতেও তারা বের হতে সমর্থ হল না। তৃতীয় ব্যক্তি বললঃ হে আল্লাহ! আমি কয়েকজন শ্রমিক রেখেছিলাম। তাদের সবাইকে তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দিলাম। কিন্তু একজন তার পারিশ্রমিক রেখে চলে গেল। আমি তার পারিশ্রমিক ব্যবসায় খাটালাম। তাতে ধন-সম্পদ অনেক বেড়ে গেল। কিছুকাল অতিবাহিতের পর সে ব্যক্তি আমার নিকট এসে বললঃ হে আল্লাহর বান্দাহ্! আমার পারিশ্রমিক দিয়ে দিন। আমি বললামঃ উট, গরু, ছাগল, চাকর-বাকর যা কিছু দেখছ এ সবই তোমার পারিশ্রমিক। সে বললঃ 'হে আল্লাহ্র বান্দাহ্! তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করো না।' আমি বললাম, 'আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না।' এরপর সে সব কিছুই নিয়ে চলে গেল এবং কিছুই রেখে গেল না। হে আল্লাহ! আমি যদি আপনারই সন্তুষ্টি লাভের আশার উদ্দেশ্যে এ কাজটি করে থাকি, তাহলে আমাদের এ বিপদ থেকে মুক্তি দিন। এরপর পাথরখানা সরে গেল। অতপর তারা সকলেই বের হয়ে চলে গেল।
তথ্যসূত্রঃ (বুখারী ও মুসলিম)
[শব্দার্থে রিয়াদুস সালহীন ১ম খন্ড। পৃষ্ঠা-৯,১০,১১]
এবার নিজে কিছু কথা বলি। অন্য হাদীসে এসেছে, "প্রত্যেক কাজের ফলাফল তার নিয়তের উপর নির্ভরশীল।" যে যেমন নিয়ত করতে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য তেমন ফায়সালা করবেন।
আমাদের দৈনন্দিক কাজগুলোর পিছনের নিয়ত একটু যাচাই করা দরকার। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ "মানব ও জ্বিন জাতিকে আমি শুধু আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের থেকে কোন রিযিক চাই না এবং তাদের থেকে আমি খাবারও চাই না।" (সূরা আয্যারিয়াতঃ ৫৬-৫৭)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় একজন মুসলমানের যাবতীয় কাজ ইবাদতের মধ্যে পড়ে। মুসলমানের খাওয়া, ঘুম, বিবাহ, সংসার ইত্যাদি সবই ইবাদত। যদি তাতে নিয়ত ঠিক থাকে এবং তা আল্লাহর রাসূল(সাঃ) এর দেখানো পথে হয়।
কেউ যদি এই নিয়তে খাবার খায় যে, এই খাবার খেয়ে আমার দেহে যে শক্তি হবে তা দিয়ে আমি আল্লাহর ইবাদত করব। তবে ইনশাআল্লাহ খাবার খাওয়ার প্রাথমিক উদ্দেশ্য (ক্ষুধা নিবারন) পূর্ণ হবেই উপরন্তু নিয়তের বরকতে নেকীর অধিকারী হবেন। আর কারো যদি শুধু ক্ষুধা নিবারনের উদ্দেশ্য থাকে তবে তাতো পুরা হবে কিন্তু নেকী থেকে বঞ্চিত হল।
কেউ যদি এই নিয়তে বিবাহ করে যে, এর দ্বারা সে আল্লাহর হুকুম পুরা করবে, হারামগমন থেকে বেঁচে থাকবে তবে বিবাহের দ্বারা তার শারীরিক ও মানসিক চাহিদাতো মিটবেই উপরি হিসেবে মহামূল্যবান নেকী অর্জন হবে।
কেউ যদি চাকুরী এই নিয়তে করে যে এর দ্বারা তার হালাল উপার্জনের একটা ব্যবস্থা হবে তবে সে তার পরিবারস্থ সকলের ভরণপোষন তো করলই আবার নেকীরও ভাগিদার হল।
কোন ছাত্র যদি নিয়ত করে আমি পড়াশুনা করছি, আমার পড়াশুনালদ্ধ জ্ঞান দ্বারা আমি ইসলামের খেদমত করব। রাসূলের (সাঃ) সুন্নাহ জিন্দা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করব তবে সে ইসলামের খেদমত করতে পারুক বা না পারুক, তারা দ্বারা রাসূল (সাঃ) এর কোন সুন্নাহ জিন্দা হোক বা না হোক, নিজের নিয়তের বরকতে নেকীর ভাগিদার হবে।
এমনিভাবে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র সকল কাজ দাত ব্রাশ করা, গোসল করা, বাজার-সদাই, সন্তান-সন্ততির লালন পালন, বাবা-মার খেদমত-ইত্যাদি সকল কাজ ইবাদতের মধ্যেই গন্য হবে যখন তার নিয়ত ঠিক হবে এবং রাসূল (সাঃ) এর তরীকায় হবে।
কিছুদিন আগে কম্বোডিয়ান এক ভাইয়ের কাছে ঘটনা শুনলাম। করাচীর এক মসজিদে এক তাবলীগ জামাত সবাইকে বিদেশে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে সফর করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করছিল। সেখানে সবাই নিয়ত করলেও একটি কিশোর ছেলে নিয়ত করছিল না। তাকে যখন বক্তা বললেন, তুমিও নিয়ত করো। তখন সে জবাব দিল, আমার চুল ফেলে দেবার জন্য ব্লেড কেনার মত পয়সা আমার কাছে নেই। আমি কিভাবে বিদেশ সফর করব? ভাই বললেন, তুমি এখন নিয়ত করো। তোমার যখন সুযোগ হবে তখন যাবে। সে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যদি আমাকে যেতে না হয় তবে আমি নিয়ত করলাম।
অতপর সেই ছেলেটির যখন ৬৭ বছর বয়স তখন তার পাসপোর্টে ৭০ টি দেশের সীল ছিল! (অথবা ৭০ বছরে ৬৭)
মহান আল্লাহ্ তাআলা বলেন,"তোমাদের কুরবানীর পশুর গোশত ও রক্ত আল্লাহ্র কাছে কক্ষনো পৌছে না। বরং তোমাদের তাকওয়া বা আল্লাহ্ ভীতিই তার কাছে পৌছে। (সূরা হজ্বঃ৩৭)
অন্য হাদিসে আছে, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদের বিচার হবে তাদের মধ্যে একজন শহীদ থাকবেন। তাকে আল্লাহর দরবারে দাড় করিয়ে তার উপর আল্লাহর প্রদত্ত নেয়ামত সমূহ দেখানো হবে। সে সেগুলো চিনতে পারবে এবং স্বীকার করে নেবে। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, এই সমস্ত নেয়ামতের বিপরীতে তুমি কি করেছো? তখন সে বলবে, ইয়া আল্লাহ্! আমি তোমার রাহে যুদ্ধ করেছি এবং শহীদ হয়েছি। এরশাদ হবে, মিথ্যে বলছো। সেটাতো তুমি এইজন্য করেছিলে যে, লোকে তোমাকে বীর বলবে। তাতো বলা-ই হয়েছে।
এরপর তাকে ফায়সালা শোনানো হবে এবং অধমুখো করে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তারপর যার বিচার হবে তিনি একজন আলেম হবেন। তাকে ডেকে এনে তার উপর প্রদত্ত নেয়ামত সমূহ দেখানো হবে। সে তা স্বীকার করে নিবে। এরপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, এইসব নেয়ামতের মোকাবেলায় তুমি কি আমল করেছো? সে বললে, ইয়া আল্লাহ্! আমি সারাজীবন তোমার কালামের জ্ঞান ধারন করেছি। তার রক্ষনাবেক্ষন করেছি। এরশাদ হবে, মিথ্যে বলছো! সেসব তো তুমি করেছিলে যেন লোকে তোমাকে বড় আলেম বলবে। সেতো বলা-ই হয়েছে।
এরপর তাকেও ফায়সালা শোনানো হবে এবং অধোমুখে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তারপর যাকে বিচারের জন্য আনা হবে তিনি একজন ধনী লোক হবেন। তাকেও তার উপর প্রদত্ত নেয়ামত সমূহ দেখানো হবে। সে ওসব চিনতে পারবে। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে এই নেয়ামতের তুমি কি শুকরিয়া আদায় করেছো? সে বললে, আমার ধনসম্পদ আমি যথা সাধ্য আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয় করেছি। বলা হবে, মিথ্যে বলছো। ওসবতো তুমি এই কারনে করেছিলে যে, লোকে তোমাকে দাতা বলবে। লোকেরা তাতো বলেছেই।
এরপর তাকেও ফায়সালা শোনানো হবে এবং অধোমুখো করে টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের নিয়ত ভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করুন। লোকদেখানো আমল হতে হেফাজত করুন।
ছোট্ট আমাদের জীবন, সময় খুব অল্প। এই সময়ের মধ্যেই আমাদের পরকালের জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে। সুতরাং এই ছোট্ট জীবনের সব কাজই যেন আমল হয়ে যায় সেভাবে আমরা আমাদের নিয়তকে সংশোধন করে নেব।
ইনশাআল্লাহ! আমরা সফলকাম হব।
No comments:
Post a Comment